ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

বাড়িভাড়া ও দ্রব্যমূল্যে চিড়েচ্যাপ্টা জীবন

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২৪, ০৯:৪৬ এএম

বাড়িভাড়া ও দ্রব্যমূল্যে চিড়েচ্যাপ্টা জীবন

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

চলমান সময়ে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোর দাম ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে অসহনীয় হয়ে উঠেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম ও বাসাভাড়া। চাল-ডাল, মাছ-মাংস, তেল-তরিতরকারি, ফলমূল-চিনি, লবণ-গম, আটা-দুধ, ডিম-রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি পণ্যের দাম আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে তা আর কমে না। অথচ এর কোনো প্রতিকারও হচ্ছে না। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তাদের কার্যক্রম লক্ষণীয় নয়। ক্যাব ভোক্তা অধিকার কতটুকু সংরক্ষণ করতে পারছে, তা একটা বড় প্রশ্ন।

জিনিসপত্রের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসাভাড়া। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাড়িওয়ালারা দফায় দফায় বাসাভাড়া বাড়ায়। এ অবস্থায় পরিবারের খরচ মেটানো বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

যদিও ঢাকা সিটি করপোরেশনে মহানগরীর বাসাভাড়া নিয়ে একটি সেল রয়েছে এবং ঢাকা মহানগরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে বিভিন্ন অবকাঠামো অনুযায়ী কোনো এলাকায় কত ভাড়া হবে তা নির্ধারণ করে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বর্তমান সিটি করপোরেশনে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাজের সুযোগ না থাকায় সৃষ্টি হয়েছে আরেক সংকট। সিটির সেই নিয়ম শুধু কাগজেই শোভা পাচ্ছে, বাস্তবে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। এতে যেমন ভাড়াটিয়াদের গুনতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া এবং সরকারকেও বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।

বছরের ১১তম মাস নভেম্বর চলছে। এ সময়ে বা পরের মাস ডিসেম্বরে সাধারণত রাজধানীসহ সারা দেশের বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়ানোর মহোৎসবে মেতে ওঠেন। তাদের হিতাহিত জ্ঞান ও আচরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও গল্প-কৌতুক প্রচলিত আছে। তাদের নির্মমতার উদাহরণ মাঝে মাঝেই গণমাধ্যম গরম হয়ে ওঠে। এ মাসে কতজন ভাড়াটিয়া নোটিশ পেয়েছেন নেই হিসাব পাওয়া কঠিন। তারা নিজেদেরকে এখনো জমিদার ও প্রভু মনে করেন অধিকাংশই। তাদের প্রতিবছরে নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই; তবু বছরান্তে তারা অযৌক্তিকভাবে ভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। মুখ বুজে ভাড়াটিয়াদের এ অত্যাচার মেনে নেওয়া বা বাসা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

রাজধানীতে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষের আয়ের অর্ধেকই চলে যাচ্ছে বাসাভাড়ার পেছনে। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জীবনযাপনের অংশ হিসেবে বাসস্থানের অর্থাৎ বাসাভাড়া নিয়ে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপ আর যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয় ভাড়াটেদের। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে জড়ো হয়। তাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই দরকার হয়। বাসাভাড়ার এমন চাহিদা দেখে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িওয়ালারা ভাড়ার বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেন ভাড়াটেদের কাঁধে।

দেখা গেছে, রাজধানীতে গত একযুগ ধরে বাড়িভাড়া বেড়েই চলছে। ক্যাবের এক সমীক্ষা মতে, গত ২৫ বছরে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় রাজধানীতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। বাসাভাড়া-সম্পর্কিত আইনের যেমন প্রয়োগ নেই, আইনটি যুগোপযোগীও করা হয়নি। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের।

বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা দুপক্ষের জন্য হলেও, বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা তা মানতে চায় না। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ভাড়াটেদের। বাড়িওয়ালারা তাদের খেয়াল খুশিমতো প্রতিবছর ভাড়া বাড়ায়। অথচ ১৯৯১-এর আইনে বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। মানসম্মত ভাড়া, বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্নির্ধারণ করা যাবে।

এই আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ভাড়াটের কাছে বাড়িওয়ালা জামানত বা কোনো টাকা দাবি করতে পারবেন না। এক মাসের বেশি অগ্রিম ভাড়া নেওয়া যাবে না। প্রতিমাসে ভাড়া নেওয়ার রসিদ দিতে হবে, নইলে বাড়িওয়ালা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ভাড়াটেদের স্বার্থরক্ষায় এমন আরও অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই।

এর আগে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। এইচআরপিবির রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন। রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না।

আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে; অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবে না। রায়ে সারা দেশে এলাকা ভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু রায় ঘোষণার ছয় বছর পার হলেও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠিত হয়নি।

রায়ে তিনটি বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। বাড়িভাড়া নির্ধারণে কমিশন গঠন, ওয়ার্ড-ভিত্তিক বাড়িভাড়া সমস্যার সমাধান ও ব্যাংকের মাধ্যমে বাড়িভাড়া দেওয়া। এর একটি ধারা সরকার বাস্তবায়ন শুরু করেছে তা হলো- ২৫ হাজার টাকার বেশি বাড়িভাড়া হলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা। যদিও ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য কৌশলে অনেক বাড়িওয়ালা এটি এড়িয়ে যাচ্ছেন।

হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণের জন্য ২০০৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা মহানগরকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে সম্ভাব্য বাড়িভাড়ার তালিকা করে। তালিকা অনুযায়ী ধানমণ্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে বাড়িভাড়া বর্গফুটপ্রতি সর্বোচ্চ ১৩ টাকা। সে হিসাবে এক হাজার বর্গফুটের একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা ১৩ হাজার টাকা। অথচ ধানমণ্ডি এলাকায় মূল সড়কের পাশে এই আয়তনের একটি বাসার ভাড়া কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত বাড়িভাড়া বাড়ির মালিকরা মানেন না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো- সরকারের কোন সংস্থা বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের কাজটি করবে, তা স্পষ্ট করে বলা নেই। ফলে ভাড়াটের স্বার্থ কেবল ক্ষোভ আর আহাজারিতেই শেষ হয়ে যায়। সিটি করপোরেশন, সরকার, রাজনৈতিক দল কোনোটাই সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসে না। প্রশ্ন হলো, বাড়িভাড়া কি বাড়তেই থাকবে? এর কি কোনো সমাধান নেই? এটি নিয়ে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। কারণ সরকার চাইলে সব কিছুই সম্ভব। সরকারের চেয়ে শক্তিশালী কেউ নয়, সরকারের চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানও নেই।

পাশাপাশি ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ কমানোর বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। কথায় কথায় ঢাকা আসার প্রবণতা কমাতে হবে। নগরায়ণে দুনিয়াজুড়েই একটি বড় সমস্যা। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৪০ শতাংশ লোক শহরের বাসিন্দা হবে। কেননা, শহরে সবধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি।

এ জন্য নিম্ন ও মধ্য আয়সহ সবধরনের লোক ঢাকামুখী। বাসার চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাড়িভাড়া বেশি। ঢাকার ওপর লোকসংখ্যার চাপ কমানো বা বিকেন্দ্রীকরণের ভাবনাটা কার্যকর করা না গেলে বাড়িভাড়া সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। রাজধানীতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের জন্য সরকারিপর্যায়ে আবাসন সৃষ্টি করলে বাসাভাড়া নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ নেই। বাড়িভাড়া নিয়ে সরকারের যে আইন আছে, তা কার্যকর করার ব্যাপারেও মনোযোগী হতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে বাড়িভাড়া কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাসাভাড়া-সংক্রান্ত আইনটিকে যুগোপযোগী করা দরকার।

একটি স্বাধীন দেশে নিয়মনীতি ছাড়া বাসাভাড়া বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া দাম একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। স্বল্প-আয়ের মানুষের জন্য তা বজ্রাঘাতের মতো। রাজনৈতিক সরকারের আমলে সরকার সমর্থক রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়িয়েছে।

এখন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সরকার ক্ষমতায়। সরকারকে কঠোর হাতে এসব অতিলোভী অসাধু ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষেকে আরেকটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে।
 

আরবি/জেআই

Link copied!