ঢাকা মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

গ্রামসংস্কৃতির রূপান্তরে সময়ের চিত্রধারণ

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২৪, ০৯:৫২ এএম

গ্রামসংস্কৃতির রূপান্তরে সময়ের চিত্রধারণ

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর আদল সমূলে বদলে যেতে শুরু করেছে। গ্রামীণ রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ শক্তির দ্বন্দ্ব আজ এক শক্তিশালী প্রবণতা। গ্রামে মণ্ডল, মাতুব্বর, খাঁ, চৌধুরী বা মিয়া বাড়িকেন্দ্রিক যে আধিপত্য ছিল, তা ক্ষয়ে গেছে। গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোতে ভূমিমালিকদের একক আধিপত্য আর অবশিষ্ট নেই। তাদের শক্তির বিন্যাস মূলত গ্রামকেন্দ্রিক। তদেরও রয়েছে বহিঃস্থ রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সংযোগ। তবে তা নতুন নগদার্র্থ শ্রেণির যে বিকাশ তার তুলনায় কম।  

চাষাবাদে বৈচিত্র্য, অকৃষিপণ্যের সম্প্রসারিত বাজার এবং বিদেশি মুদ্রা এ নতুন শ্রেণি বিকাশের পথকে মসৃণ করছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারায় জমিনির্ভর আধিপত্যশীল শ্রেণির ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। জমিমালিকদের উত্তরাধিকার বৃদ্ধি পাওয়ায় জমির পরিমাণও কমেছে জ্যামিতিক হারে। যাদের একসময় চারশ বা পাঁচশ বিঘা জমি ছিল, তা তৃতীয় প্রজন্মে এসে ঠেকেছে দশ-কুড়ি বিঘাতে। মূল মালিক মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালিকানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, সামাজিক মর্যাদা সুরক্ষা, ক্ষমতার আধিপত্য ও রোগব্যাধি, মামলা-মোকদ্দমা, নেশা  ইত্যাদি বিষয়গুলো জমি হারানোর বড় সূচক হিসেবে কাজ করেছে। জমির মালিকরা নানা কারণে জমি বিক্রি করেছেন। জমি বিক্রি করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে অভিযোজিত হতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু জমির পরিমাণ যত কমেছে, ততই তাদের শক্তি-সামর্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ছে।

গ্রামীণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মূল উৎস জমির পরিমাণ যত কমছে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো ততই ভিন্নরূপ ধারণ করছে। জমি হারানোর ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার লড়াই অনেক বড় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আশির দশক থেকে ভূস্বামীরা মূলত জমি হারাতে শুরু করেন। ১৯৯০-এর দিক এসে তা গতি পায় এবং ২০২০-এর দিকে এসে তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যায়। ভূমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে যাওয়ায় এ ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর অবস্থান গ্রামীণ রাজনীতিতে ক্রমেই প্রান্তিক হতে থাকে। একসময়কার ধান ও মাছনির্ভর অর্থনীতির জায়গায় এসেছে, বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক তৎপরতা ও অকৃষিজাত এবং সেবানির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।  

উৎপাদন কাঠামো বদলে যাওয়া বা ভূমির একক মালিকানা কমে যাওয়ায় ভূমির ব্যবহারিক মূল্য অনেকগুণ বেড়েছে। কার্ল মার্কসের ভাষায় সেই ‘স্থবির ও অচল’ গ্রাম আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গ্রামগুলো এখন পূর্ণযৌবনা। উৎপাদনমুখর। গ্রামের মানুষের অলস সময় বলে কিছু নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার বেড়েছে কর্মচঞ্চলতা। গ্রামগুলো হয়ে উঠছে এক গতিশীল অর্থনীতির সূতিকাগার। গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন বহুমাত্রিক। গ্রামে অকৃষি ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। গ্রামে আসছে প্রবাসী আয়, যাচ্ছে শহর থেকে নগদ অর্থ। বিনিময়ে গ্রাম দিচ্ছে খাবার জোগান। গ্রাম মানেই জোগানদাতা। শহরের মানুষ উৎপাদন করে শিল্পপণ্য আর গ্রাম জোগান দেয় বেঁচে থাকার শক্তি।

প্রতিদিন গ্রাম থেকে আসছে হরেক রকম শাক-সবজি, মাছ, মুরগি আরও কত কিছু। গ্রাম আজ নানা ধরনের পণ্য জোগানে উদগ্রীব। গ্রামের মাটির রয়েছে এক পরার্থবোধ। অন্যকে খাইয়ে সে মজা পায়। এ জমিন কেবল তার মালিকের নয়, সেই ধারণ করে অন্যের সুখ-দুঃখবোধ। ভূমিনির্ভরতা গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম মৌলক পাটাতন।

১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত গ্রাম থেকে উৎপাদিত পণ্য বলতে ধান, গম, আলু, পাটসহ নানা কৃষিপণ্য, হাঁস-মুরগি, গরু ও ছাগল ইত্যাদি বিবেচনা করা হতো। এগুলো বিক্রি করে গ্রামের মানুষ আয় করত। সংসার চালাত। সেই সময় গ্রামে চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের তেমন প্রসার ছিল না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ছিল কেবল সাপ্তাহিক হাট। ব্যাংক, বিমা ও এনজিওর তেমন অনুপ্রবেশ ঘটেনি। ধারদেনা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির একটি বিশেষ দিক। গ্রামের সার্বিকচিত্র আজ সমূলে বদলে গেছে। প্রতিটি গ্রাম আজ বেচা-কেনার অনন্য ক্ষেত্র। আলু, বেগুন, তরিতরকারি, ধান, চাল, গবাদিপশু, দুধ-ডিম, হাঁস-মুরগি যাচ্ছে শহরের বাজারে। গ্রামের এ জোগানমুখিতা বেড়েছে অনেকগুণ। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের অনেক গ্রাম এখন আন্তর্জাতিক ভ্যালু চেইনের সঙ্গে যুক্ত।

যা হোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক, গেরস্থ যারা জমির মালিক ছিলেন এবং এর ওপর নির্ভর করে জীবনধারণ করতেন তারা পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে আজ খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তাদের মধ্যে যে ‘জমিদারি’ ভাব গড়ে উঠেছিল, সেখান থেকে তারা নিচের দিকে নামতে পারেননি। জমির সঙ্গে তাদের তৈরি হয়েছে এক দূরবর্তী সম্পর্ক। এ সম্পর্ক যত দূরবর্তী হচ্ছে ক্ষমতা ও প্রভাববলয় থেকে তারা তত ছিটকে যাচ্ছে। ক্ষমতাকাঠামো থেকে ছিটকে পড়ায় জমির মালিকরা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছে। তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে অবস্থান করতে প্রাণান্তর চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা আর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। অনেকে জমিজমা বেচে শহর বা উপশহরের দিকে আবাসস্থল গড়তে বাধ্য হচ্ছেন। গ্রামে জমির মালিকরা তাদের অবশিষ্ট জমি অন্যদের কাছে লিজ দিচ্ছেন। জমিমালিকদের লাঙল-জোয়াল ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ শিকেয় উঠেছে। অনেকে ধানের জমি আলু চাষ, পেয়ারা বা আম, কমলা চাষের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বছরভিত্তিক চুক্তিতে লিজ দিচ্ছেন।

জমির সঙ্গে জমিমালিকদের সম্পর্কের যে বিচ্যুতি ঘটেছে তা এক করুণ প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। যে যত্ন-আত্তি দিয়ে জমির মালিক জমি চাষ করতেন সেই জমি কন্ট্রাক্টে চলে যাওয়ার পর জমির প্রতি আচরণ হয়েছে নির্বিচার। জমিকে বাধ্য করা হচ্ছে, অধিক ফসল উৎপাদনে। প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে প্রয়োগ করা হচ্ছে সার ও কীটনাশক। জমির প্রতিটি কোনায় গেঁথে দেওয়া হচ্ছে বিষাক্ত পেরেক। এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে, তা বলা মুশকিল?

জমির সঙ্গে জমির মালিকদের চিরায়ত সম্পর্কটি বহিঃস্থ শক্তি বা চুক্তিভিত্তিক শক্তির প্রভাবে ঠুনকো হয়ে উঠছে। শহর বা উপ-শহরের নব্য লগ্নিকারী কৃষিজমি ঘিরে প্রজেক্ট করছেন। স্থানীয় ফড়িয়া, গভীর নলকূপের মালিক এবং বহিঃস্থ পুঁজির ত্রি-মাত্রিক রসায়নে গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোর নতুন রূপ লাভ করছে।

একটি বড় কৃষি প্রজেক্টের আওতায় একজন কৃষকের পাঁচ বিঘা জমি থাকলে চাষাবাদের বিষয়ে তিনি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। কারণ, চাষাবাদের জন্য তার পানির দরকার। এ জন্য তিনি অনেকাংশে গভীর নলকূপের মালিকের কাছে জিম্মি। কাগজে-কলমে তার জমি থাকছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অন্যেরা। একে বলা হচ্ছে, কৃষিতে নয়া সামন্তবাদ। এ নেক্সাস গ্রামীণ ক্ষমতা সম্পর্কের নতুন রূপ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। 
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- গ্রামে জমির পরিবর্তে নগদ টাকাকেন্দ্রিক এক শ্রেণির উত্থান দেখা যাচ্ছে। যাদের সে অর্থে জায়গা-জমি নেই কিন্তু হাতে রয়েছে নগদ টাকা। আলু বা মাছের প্রজেক্ট করে অনেকে ভালো অর্থ জমাচ্ছেন। নগদ টাকানির্ভর এ শ্রেণির বিকাশ ক্রমেই গতিশীল হচ্ছে। গ্রামে এখন কোটিপতির সন্ধান মিলছে।

জমির তুলনায় নগদ অর্থকেন্দ্রিক যে শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে, তারা গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামোতে এ বেশ শক্ত জায়গা দখল করেছেন। কারণ, তাদের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয়। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে চাঁদা দিতে হয়, দয়ার হাত বাড়াতে হয়, অনুদান দিতে হয়। কেবল সামাজিক বা রাজনৈতিক না ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও তাদের যথেষ্ট অংশীদারত্ব থাকছে। তারা সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কের নানা স্তরে নতুনভাবে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছেন। সেই সামর্থ্যও তাদের তৈরি হয়েছে।

এ নতুন শ্রেণি পুঁজি সুসংহতকরণে পারঙ্গম। পুঁজির স্ফিতিকরণে তারা যথেষ্ট দক্ষ। নগদ অর্থজীবী শ্রেণি গ্রামীণ ও বহিঃস্থ দুই ধরনের সম্পর্ক সুরক্ষা বেশ নিপুণ। তারা বাজার ব্যবস্থাও ভালো বোঝেন। বাজারের খোঁজখবর রাখেন। অনেক কিছু ম্যানেজ করে চলতে তারা দারুণভাবে অভ্যস্ত। তারা নিজে পরিশ্রম করেন, সংযুক্ত থাকেন। গ্রামীণ এ শ্রেণি রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা শহরসহ সব ধরনের মার্কেটের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন, তাদের ব্যবসার স্বার্থে।

অন্যদিকে, জমির মালিকরা সাধারণত আপসকামী নন। তারা সহজেই অন্যের কাছে ছোট হতে চান না। কিছুটা আত্মগরিমায় ভোগেন। তাদের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ ভাব লক্ষ্য করা যায়। সহজেই অন্যকে তোয়াজ করতে পারেন না, হুজুর হুজুর করতে পারেন না। তারা নিজস্ব পরিচয়, জমিজমা ও চাষাবাদ নিয়ে এক ধরনের বিশেষ আত্মপরিচয় নিয়ে বাস করতে অভ্যস্ত। আরেকটি বিশেষ অর্থনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটেছে তারা হলো- প্রবাসী শ্রমিক ও অকৃষি পণ্যকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী শ্রেণি। কারণ গ্রামে আধুনিক জিনিসপত্র বিশেষত শ্যালো-মেশিন, গভীর নলকূপ, ফ্রিজ, ওভেন, টিভি ও মোবাইল, টেলিভিশন, মোটরসাইকেলসহ নানা উপকরণের চাহিদা বেড়েছে।

মাটির পরিবর্তে পাকা বাড়ি নির্মাণের প্রবণতা অনেকগুণ বেড়েছে। এতে নতুন ব্যবসা যেমন- রড, সিমেন্ট, টয়লেট, সাবমারসিবল টিউবওয়েল, বালি, ইট, রং, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের চাহিদাও ব্যাপক বেড়েছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গ্রামে নগদে পণ্য কিনতে পারেন অনেকে। এতে নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রসার ঘটেছে। তারা গ্রামের মানুষদের পুঁজি আনতে সক্ষম হচ্ছেন। আমরা জানি, পুঁজির একক কোনো প্রভাব নেই, এর রয়েছে নানামাত্রিক প্রভাব। বিভিন্ন সামাজিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক ইস্যুতে তারা অন্যের সম্মতি প্রয়োজন হয়। গ্রহীতা যেহেতু কাজের ফাঁদে বাধা থাকেন তাই তাকে সেই ব্যবসায়ীর সুরে কথা বলতে হয়। এভাবে গ্রামের সমাজে তৈরি হচ্ছে এক বিশেষ অনুগত শ্রেণি। জমি হারানো এ শ্রেণিটি নতুনভাবে আবির্ভূত নগদ টাকানির্ভর শ্রেণির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না। পারছে না গ্রামীণ ক্ষমতাকাঠামো নিয়ন্ত্রণে কুলিয়ে উঠতে।

আরবি/জেআই

Link copied!