৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র ও জনতার সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ৫ আগস্ট সকালে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে সেনাপ্রধানের কাছে দেশের দায়িত্বভার দিয়ে একটি হেলিকপ্টারে করে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন, সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা।
৬ আগস্ট ২০২৪ রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সংসদ বাতিল করেন। সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর প্রধান, ছাত্র আন্দোলন তথা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫ জন নেতা ও দুজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ রাত ১২টা পর্যন্ত পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য আলাপ-আলোচনা করেন। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ১৫ জনের একটি তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করেন উপদেষ্টা করার জন্য। আর এই উপদেষ্টার প্রধান নাম প্রস্তাব করে নোবেল বিজয়ী, বিশ্ববরণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মোহাম্মদ ইউনূস। আজ আমার মনে পড়ছে ১৩ অক্টোবর ২০০৬ সালের দিনটির কথা। যেদিন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে যৌথভাবে তৃণমূল পর্যায় থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নোবেল কমিটি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে সারাদেশের মানুষ আনন্দের জোয়ারে ভাসে।
আজ সেই আনন্দের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ‘নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস’ শীর্ষক গ্রন্থ সম্পাদনা করে তার হাতে তুলে দেওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার।
বিলম্বে হলেও অভিনন্দন জানাই আজ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। অভিনন্দন ছাত্র সমাজকে। ৮ আগস্ট’ ২৪ শপথ নিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং আরও ১৭ জন উপদেষ্টা সদস্যদের মধ্যে ১৪ জন শপথ নিয়েছেন।
নতুন সরকার ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর যাত্রা শুরু করল। আমরা নবগঠিত সরকারের সফলতা কামনা করি। দীর্ঘ ১৭ বছর শেখ হাসিনার শাসনের ফলে রাষ্ট্রে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তাকে নির্মূল করা বর্তমান নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ।
জরুরি কাজসমূহ হচ্ছে----
১) রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা : ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্কিয় হয়ে পড়ে। থানাগুলো অরক্ষিত। পুলিশের কোনো কাজ বা তৎপরতা নেই। কর্মবিরতি পালন করেছে। পুলিশের নতুন আইজি দায়িত্ব নিয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের মাধ্যমে যারা আইন অমান্য করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের মাধ্যমে সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। আইন বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও দলীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। দলীয় আদর্শের ব্যক্তিদের সরিয়ে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচারক নিয়োগ দিতে হবে।
২) ব্যাংক ও অ-আর্থিক খাতের সংস্কার : দেশে ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের মুখে পড়ে আছে। এক ব্যক্তি, এক পরিবারকেন্দ্রিক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো আজ ডুবন্ত অবস্থায়। নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপেশাদার ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাংকিং খাত একেবারে ধরাশায়ী। দ্রুত একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে ব্যাংকিং সেক্টরে ও শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার শুরু করতে হবে। এই কমিশন অবশ্যই দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ সব অনিয়মের বিরুদ্ধে একটি শে^তপত্র প্রকাশ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সরিয়ে সৎ, যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে নিতে হবে। ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গিয়েছে। ব্যাংকসমূহ শূন্য। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করা জরুরি। ব্যাংকের আইনে সংস্কার আনতে হবে। একই পরিবার বা একই ব্যক্তির কাছে ব্যাংক কুক্ষিগত হওয়ার সব সুযোগ বাতিল করতে হবে। অর্থ পাচার ব›দ্ধ করতে পারলে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে পারলে ব্যাংকিং খাত স্বচ্ছ হবে।
৩) দুর্নীতি দমন কমিশন : দুর্নীতি দমন কমিশনকে নতুন করে সাজাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কমিশন থেকে বের করে দিতে হবে। নতুন, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে। রাষ্ট্রে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই সরকারের প্রধান ও অন্যতম কাজ হচ্ছে বিগত সরকারের আমলে ঘটিত দুর্নীতির বিচার যথাযথভাবে করা। যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার পথে সকল অন্তরায় দূর হয়।
৪) নির্বাচন কমিশন : দেশের প্রধান সমস্যা আজ নিরপেক্ষ, সৎ মানুষ দ্বারা না ঘটিত হওয়া নির্বাচন কমিশন। একটি সরকারি দলের আজ্ঞাবহ কমিশন দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই কমিশনকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে। সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন প্রধান কাজ। ভুয়া ও অনিয়ম ভোটারকে বাদ দিয়ে সত্যেকার ভোটার তালিকা প্রণয়ন এই কমিশনের অন্যতম কাজ এবং পরবর্তী সব নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও নিয়মমাফিক করার শক্তির অর্জন করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব।
৫) শিক্ষাব্যবস্থা : দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। দলীয় ব্যক্তিদের দিয়ে বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব স্তর আজ দুর্নীতি ও অনিয়মে ভরপুর। দলীয় ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। দ্রুত কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাকে গঠন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তথা উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সংস্কার করতে হবে।
৬) পাবলিক সার্ভিস কমিশন : দেশের একমাত্র অন্যতম কমিশন হচ্ছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। যোগ্য ও মেধাবীদের পরিবর্তে দলীয় দৃষ্টিতে বিগত ১৬ বছর ধরে নিয়োগ চলেছে। এই সংস্থাকে নতুন করে পুনর্গঠন করতে হবে। কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সব সদস্যর কার্যক্রম মূল্যায়ন করে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনিয়ম ও দুর্নীতি এই কমিশনকে দুর্বল করে ফেলেছে। সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে নতুন করে গঠন করতে হবে। পরীক্ষা পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মকে আইনের মাধ্যমে চিরতরে দূর করতে হবে।
৭) তৈরি পোশাকশিল্প ও বস্ত্র খাত : আমাদের দেশে এখনো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হচ্ছে বস্ত্র খাত তথা তৈরি পোশাকশিল্প। এই খাতে আরও বেশি সহযোগিতা দিতে হবে। ভারতের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। সুতা আমদানির ওপর নীতি ও সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। কোনো আমদানিকারক রপ্তানির জন্য ৪০ শতাংশের অধিক সুতা আমদানি করতে পারবে না এই মর্মে আদেশ প্রদান করলে তৈরি পোশাকশিল্প তথা বস্ত্র খাত রক্ষা পাবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। রপ্তানিও দ্বিগুণ বাড়বে। আমদানি কমে আসবে। তাহলে অসম প্রতিযোগিতা থেকে স্পিনিং খাত রক্ষা পাবে। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য ৫০ শতাংশ হ্রাস করতে হবে। এত বেশি গ্যাসের মূল্য দিয়ে স্পিনিং খাতসহ তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ব্যাংকের দেনা তার স্পিনিং খাতে দিনের পর দিন বাড়ছে এবং অনেক স্পিনিং মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাতে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। বেকার বাড়ছে। স্পিনিং খাতের উত্থানের মাধ্যমে তৈরি পোশাকশিল্প আজ আমাদের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এটা পতন খাত হয়ে আছে।
৮) সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গ : আমাদের সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রথম প্রণীত হয়। পরবর্তীকালে অনেক সংশোধন হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্যতার অভাব আছে। তাই সংবিধান সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একটি উচ্চপর্যায়ে শক্তিশালী সংবিধান সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করা দরকার। ওই কমিটির পরামর্শক্রমে পরবর্তী সংসদ সংবিধানকে সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করে উপর্যুক্ত পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। তাতে দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলসমূহ উন্নতিরদিক নির্দেশনা পাবে।
কিছুদিন আগে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের নিমিত্তে ৩১ দফা একটি কর্মসূচি জাতির সামনে পেশ করেছে। উক্ত ৩১ দফা অনুযায়ী রাষ্ট্র মেরামতের কাজ বর্তমান সরকার শুরু করলে জাতি বড়ই উপকৃত হবে।
৯) জাতীয় নির্বাচন: এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সবার গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অতিবিলম্ব এক্ষেত্রে সবার জন্য কষ্ট নিয়ে আসবে- সেই দিকে সরকারকে বেশ যত্নবান হতে হবে।
১০) বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন : শহীদ পাঠ্যপুস্তকে স্থান এই আন্দোলনে হাজারের ওপরে ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন অসংখ্য। ওই বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দ্রুত কত নিহত ও আহত হয়েছে, তা নির্ধারণ করা। দ্বিতীয়ত. আহতদের সুচিকিৎসা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা। আর যারা নিহত তথা শহীদ হয়েছে শহীদের ভাতা চালু করা। অন্যদিকে এই হত্যা কার্যকর নির্দিষ্ট করা এবং এই সুষ্ঠু সঠিক বিচারের ব্যবস্থা করা এ সরকারের প্রধান ও অন্যতম দায়িত্ব। হত্যাকারীর বিচারের ব্যবস্থা ও কার্যকরণ করা জাতি দেখতে চায়। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সূচনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে অবশ্যই পাঠদানের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে এই আন্দোলনের বর্ণনা আনতে হবে।
১১) শেখ হাসিনা সরকারের আমলের ওপর দুর্নীতির, অন্যায় অবিচারের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের ব্যবস্থা করা উচিত। যার ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সহজ হবে।
১২) স্বৈরশাসক ও তাদের সহযোগীদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থাপনার নাম অবিলম্বে পরিবর্তন করে দেশপ্রেমিক ও শহীদদের নামে নামকরণ করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীবালীন সরকার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া উচিত।
১৩) তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দ্রুত সংস্কার করা প্রয়োজন। এই খাতে বিগত বছরগুলোতে দুর্নীতি ও অনিয়মের শে^তপত্র প্রকাশ করা উচিত। চিহ্নিত দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বর্তমানে এই খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের জন্য বেশি অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। এই খাতে গৃহিত প্রকল্পসমূহ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যে প্রকল্প লাভজনক নয়, কিন্তু শুধু নামের জন্য করা হয়েছে, তা বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
আপনার মতামত লিখুন :