এই পৃথিবীকে এতদূর এগিয়ে আনতে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তা হলো বিজ্ঞান। আবার আজ যে এত ধ্বংসের আয়োজন সেটিও বিজ্ঞানের জন্যই! মানুষ আছে এক ধরনের উভয় সংকটে। না পারছে বিজ্ঞানকে ছাড়তে আর না পারছে ভালো কাজে বেশি প্রয়োগ করতে। এর কারণ হলো, যদি সমস্যা বিজ্ঞানের জন্য হয় তবে সমাধানও কিন্তু সেই বিজ্ঞানেই নিহিত।
বলতে চাচ্ছি, এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। অনেক দূরে যাওয়ার দরকার নেই, সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের সঙ্গে যে টানাপোড়েন সেখানেও ভারতের পতাকা মাড়ানোর একটি দৃশ্যকে ফ্যাক্টচেক বলছে সেটি এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে! অথচ এই ছবিটি নিয়ে কি না ঘটে গেল! আমরা আজ সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে খুব দ্রুত সব দেখে ফেলি এবং উত্তেজিত হই। সেটি সত্যি না মিথ্যা সেটা নিয়ে গবেষণা করি না।
যতক্ষণে গবেষণা হয় ততক্ষণে অনেক ঘটনা ঘটে যায়। এআই ভালো না মন্দ সে হিসাব করার সময় সম্ভবত এখনো আসেনি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি উল্লেখযোগ্য এআই হলো চ্যাটজিপিটি যা একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ভিত্তিক সার্চ টুল। একটা চ্যাট বট। মাইক্রোসফটের সহযোগিতায় চ্যাটজিপিটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ ওপেনএআই। এই চ্যাটবট তৈরি করা হয়েছে জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার ৩-এর ওপর ভিত্তি করে। এটি একটি অত্যাধুনিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এআই মডেল। এই চ্যাটবট ক্রমেই উন্নততর হচ্ছে। আবার চ্যাটজিপিটির প্রতিদ্বন্দ্বী গুগলের বার্ড চ্যাটবট বাজারে এনেছে। এখানেই শঙ্কা রয়েছে। যখন একটি প্রতিষ্ঠান কোনো প্রযুক্তি বাজারে আনবে এবং বাজারে সাড়া ফেলবে ঠিক সেসময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান তার থেকে উন্নত কোনো মডেল আনার চেষ্টা করবে এবং আনবে।
এই যে কম্পিটউটার, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন অ্যাপস, সফটওয়্যার ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রেই এমনটাই ঘটেছে। অর্থাৎ এসব উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যদি একই ঘটনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও ঘটে তাহলে তা শুধু ছড়াতেই থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো যদি এক সময় এর নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে না থাকে তখন কী ঘটবে? প্রতিযোগিতার নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে থাকবে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হতে পারে। এ সম্ভাবনা কি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়? কারণ যেভাবে এর জনপ্রিয়তা ব্যবহার এবং উত্থান ঘটছে তাতে ভবিষ্যতের কিছু শঙ্কা তো এসেই যায়। এই মডেল দ্বারা চ্যাটবট সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং যুক্তিযুক্তভাবে ফলাফল প্রদর্শন করে। যত সমালোচনাই আসুক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা থেমে নেই। এর আধুনিক প্রযুক্তি এখন রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করছে।
তবে সময় যতই এগিয়ে চলেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে শঙ্কাও জাগছে। বিশেষজ্ঞরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত। তবে এটি যে মানুষের চিন্তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত। অনেকেই এখনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বন্ধ করার পক্ষে। আবার কেউ কেউ এটিকে এগিয়ে নিতে চাচ্ছেন। এর কারণও রয়েছে। সম্প্রতি জানা গেছে, বিজ্ঞানী, ডাক্তার ও গবেষকদের বানানো নতুন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমতা প্রায় নির্ভুলভাবে ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হবে একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। এখানে প্রশ্ন হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে তখন তুলনামূলক কম বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে মানব জাতির ভবিষ্যৎ কী হবে? কারণ এখন পর্যন্ত এই মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষই স্বীকৃত। মানুষ কি নিজের চেয়ে বুদ্ধিমান কাউকে (হোক যন্ত্র ) পৃথিবীতে রাজত্ব করতে দেবে? এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। প্রশ্নটি মানব জাতির অস্তিত্বে¡র। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুবিধা যতই আমরা নিই না কেন এর প্রধান আঘাতটা আসবে চাকরির বাজারে। এটা অনুমেয়ই ছিল এবং হচ্ছেও তাই।
শিক্ষকতা থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স অথবা সংবাদপাঠ সবই করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট। এখন এসব যন্ত্রই যদি সবকিছু করে তাহলে মানুষের চাকরির ভবিষ্যৎ কী? টেসলার মালিক ও স্পেসে এক্স-এর প্রতিষ্ঠিাতা ধনকুবেরে ইলন মাস্ক বলেছেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজিন্সে (এআই) আমাদের সব চাকরি কেড়ে নেবে। প্যারিসে ভিভাটকে ২০২৪-এর প্রযুক্তি সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য এআই নিয়ে মাস্ক বলেন, ‘সম্ভবত ভবিষ্যতে আমাদের কারও চাকরি থাকবে না।’ মাস্ক বলেন, যদি আপনি কোনো সৃজনশীল কাজ করেন তাহলে হয়তো চাকরি করতে পারবেন। এ ছাড়া এআই ও রোবট আপনাকে যে কোনো পণ্য এবং পরিষেবা সরবরাহ করবে আপনি যা চাইবেন। পণ্য বা পরিষেবার কোনো অভাব থাকবে না। তিনি বলেছেন, রক্ত মাংসের মানুষের পক্ষে যে কাজগুলো করা সম্ভব নয়। সেগুলোও অনায়াসে করে ফেলতে পারে রোবট।
এআই-এর ছোঁয়া থাকলে প্রতিটি কাজ হবে ত্রুটিহীন। ফলে এআই ব্যবহারে আগ্রহী হবেন বেশিরভাগ মানুষ। এখন আমরা বুঝতে পারছি যে, সামনের চাকরির বাজারে আমাদের কার সঙ্গে এবং কীসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট এখন সংবাদ পাঠ করছে, হাসপাতালে সেবা দিচ্ছে, চিকিৎসা করছে এবং লেখালেখিও করছে। অর্থাৎ মানুষ যা যা করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও সেটাই করছে। মানুষের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এমনকি চাকরির বাজার চলে যাচ্ছে রোবটের হাতে। আগে থেকেই মানুষের ধারণা ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার শুরু হলে মানুষের চাকরির বাজার কমতে থাকবে। সম্প্রতি মার্কিন বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বের ৩০ কোটি পূর্ণকালীন কর্মী চাকরি হারাবেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মোট কাজের এক-চতুর্থাংশ কাজ করে ফেলতে পারে। এর আগে বিবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এআইয়ের মাধ্যমে ছবি আঁকার কারণে নিজেদের কর্মসংস্থানের ক্ষতি হতে পারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বেশ কয়েকজন শিল্পী।
মানুষের দেওয়া বুদ্ধিতেই মানুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে এসব যন্ত্র। এখন চারদিকে যন্ত্রই সব। জোজি নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এক রোবট ১২০ ভাষায় কথা বলতে সক্ষম। জোজি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের নির্দেশনা বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী কাজও করতে পারে। একটি যন্ত্রকে বিজ্ঞানীরা বুদ্ধিমত্তা প্রদান করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করতে চাইছেন। একসময় হয়তো দেখা যাবে মানুষ ও রোবট পাশাপাশি হাঁটছে কিন্তু কোনটা মানুষ আর কোনটা রোবট আমরা বুঝতে পারব না।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ শুধু এটুকু বলেই থেমে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ঘটে। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের মতে, গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত আবিষ্কার হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের উন্নয়ন। এআই নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছেন এর আশঙ্কা প্রকাশ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক হিসেবে খ্যাত অধ্যাপক জেফরি হিন্টন বলেছেন, ‘এআই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং তার প্রভাবে মানবজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে- এটা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, আগামী ৫-২০ বছরের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করবে- এমন সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। জেফরি হিন্টন ধারণা করছেন, এআইয়ের কল্যাণে মানুষের উৎপাদনশীলতা ও আয় উভয়ই বাড়বে।
কিন্তু তার মনে আশঙ্কা, এই সম্পদ ধনীদের ঘরে যাবে। যারা চাকরি হারাবেন, তাদের ঘরে যাবে না এই অর্থ এবং সমাজের জন্য তা ভালো হবে না বলেই তিনি মনে করেন। এখন ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার যদি এআইয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় সেক্ষেত্রে বহু দেশের কপাল পুড়বে কারণ এখনো মানুষের হাতেই সভ্যতার চাবিকাঠি। সমস্ত অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রযুক্তি সবকিছু মানুষের হাত ধরেই হচ্ছে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে তা চলে যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবটের হাতে। সে কারণেই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :