ফিলিস্তিন ও লেবাননের পর এবার ইরানে সরাসরি হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। সম্প্রতি ইরানের রাজধানী তেহরানে সকাল থেকে আকাশপথে একাধিক যুদ্ধবিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকারের বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েলি দস্যুতা ও হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। কখনো ফিলিস্তিন, কখনো লেবানন, কখনো জর্ডান, কখনো ইরান ইসরায়েলি যুদ্ধ বিমানের নিশানায় পরিণত হচ্ছে। এতে অসংখ্য নিরীহ মানুষ অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছেন। গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে অনেকের দেহ।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। তার পরেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেই থেকে যুদ্ধ চলছে। একে একে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুথি গোষ্ঠী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেপথ্যে ইরানের মদদের অভিযোগ থাকলেও এতদিন সরাসরি যুদ্ধ করেনি তেহরান। অক্টোবরের শুরুতে লেবাননে ইসরায়েলি হামলার পর তেল আবিবে প্রত্যাঘাত করে তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এবার পাল্টা প্রত্যাঘাত আসতে শুরু করেছে ইসরায়েল থেকেও।
যথার্থ সাম্যবাদী শিবিরের অনুপস্থিতিতে বিশ্বের সমস্ত প্রতিবাদ প্রতিরোধ আগ্রাহ্য করে একতরফা প্রাণঘাতী রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে বিশ্বের এতগুলো দেশ কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং কেউ কেউ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলের প্রতি। ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় তারা স্বার্থের রাজনীতি ও কূটনীতির প্যাঁচ খেলছে।
আন্তর্জাতিক আইন, নীতি নৈতিকতা লঙ্ঘন করে ইসরায়েল নির্মম গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী; হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাসস্থান, ধর্মস্থান, আশ্রয় শিবির সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এ পর্যন্ত ১৪৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ আহত, ঘরছাড়া, শিবির ছাড়া, বিপর্যস্ত। অনেকে চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
ইসরায়েল ‘আত্মরক্ষা’ ও জঙ্গিগোষ্ঠীকে মোকাবিলা করার নামে বেপরোয়া হামলা চালাচ্ছে। যদিও কোনো জঙ্গি (হামাস) গোষ্ঠীর আক্রমণ, এবং সামগ্রিকভাবে কোনো সমাজের ওপর এক আগ্রাসী রাষ্ট্রের লাগাতার আক্রমণ, বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করা এক কথা নয়। সে কাজ যদি ইসরায়েলের মতো সামরিকভাবে অতীব দক্ষ ও সমৃদ্ধ দেশ করতে থাকে, এবং তাকে অনবরত নেপথ্য সহায়তা দানে উন্মুখ থাকে আমেরিকার মতো ‘সুপারপাওয়ার’, তা হলে কোনো যুক্তিতেই তাকে সমর্থন করা যায় না।
সবচেয়ে হতাশাজনক হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মানুষের আর্তচিৎকার ‘সভ্য’ দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। শব্দও যেন তার ধার হারিয়ে ফেলেছে। অথচ আমরা জানি প্রকৃতি ও মানুষের মিথস্ক্রিক্রয়াতেও শব্দই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পাখির ডাক মানুষ শুনেছিল বলেই তো সুরের সৃষ্টি হয়েছে। শব্দ যদি মানুষ শুনতে না-পায়, তাহলে সেই শব্দের ভূমিকা থাকে না। শব্দ না শোনা গেলে বিপন্ন জীবজগৎও। মানুষ বিপদে পড়লে চিৎকার করে, কিন্তু সেই চিৎকার যদি অন্য কারও কানে না পৌঁছায়, কেউ যদি সেটা শুনতে না চায়, তাহলে সমাজ বলে কিছু থাকে না। সমাজ ও জীবজগৎকে টিকে থাকার জন্য, এগিয়ে যাওয়ার জন্য শব্দ সৃষ্টি ও সেই শব্দ শুনতে পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
গত এক বছর ধরে গাজার বাসিন্দাদের আর্তচিৎকার কারও কানেই পৌঁছাচ্ছে না। সেখানে রোজ টন-টন বোমা বর্ষিত হচ্ছে, কিন্তু তার আওয়াজ কারও কানে যাচ্ছে না। গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় প্রতিদিন শত শত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। এক কথায়, এক বছর ধরে গাজায় যা ঘটছে, তা ‘গণহত্যা’। কিন্তু সেই কথাটা বলার মতো সুযোগও কোথাও নেই। সংবাদমাধ্যম একতরফা ইসরায়েলের হামলাকে ‘যুদ্ধ’ বলে গত এক বছর ধরে দেখিয়ে আসছে।
আসলে, গাজা থেকে উঠে আসা শব্দ যদি কেউ শুনতে না-পায়, তাহলে যা ঘটার তাই ঘটছে। গাজায় জনপদের পর জনপদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি বোমায় রোজ স্রেফ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে বাড়িঘর, বাজার-দোকান, হাসপাতাল, স্কুল। বোমায় রোজ জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে শত-শত শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ, যুবক। তাদের আর্তনাদ মনুষ্যসমাজের কানে ঢুকছে না। যখন গাজা থেকে শব্দের রোল উঠছে তখন যেন বধির হয়ে যাচ্ছে সবার শ্রবণ যন্ত্র। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যার পর গাজায় ইসরায়েলের হামলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছতে চলেছে বলে কোনো-কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর, হামাসের হামলায় নেতৃত্বে ছিলেন এই সিনওয়ার। সিনওয়ারের হত্যা নিশ্চিত হওয়ার পরেই লেবানন থেকে ড্রোন উড়ে এসেছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র প্রক্তিগত বাসভবনের দিকে। এ-যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবার। কিন্তু সংঘর্ষে যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়া সুনিশ্চিত হচ্ছে। ইসরায়েল, ইরান, লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়া এবং ইরাকÑ যুদ্ধক্ষেত্রের বৃত্তটা আরও বড় হচ্ছে। ইসরায়েলের কৌশলগত লক্ষ্য বজায় রাখতে মার্কিন সাহায্য, অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য অব্যাহত রয়েছে। গাজা থেকে উদ্ভূত আওয়াজের মুখে বধির হলেও মার্কিন প্রশাসনের কর্তাদের কানে ইহুদিদের দাবি পৌঁছাচ্ছে। আঞ্চলিক যুদ্ধে হামাস ছাড়াও জড়িয়ে পড়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি এবং হাশাদ আল-শাবি।
১ এপ্রিল সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় ইরানি কনস্যুলেটে ইরানি জেনারেলদের হত্যা পশ্চিম এশিয়ার এই সংঘর্ষকে ছড়িয়ে দেয়। এরপর ৩১ জুলাই ইসরায়েল হত্যা করে হামাসের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়কে। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে ইরানে গিয়েছিলেন। সেখানে ইসরায়েলের হামলা হয়। ইরান তখনই প্রতিশোধের হুমকি দেয়। ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননে একটি বিল্ডিং কমপ্লেক্সে বোমা হামলা করে শত শত বেসামরিক নাগরিকের সঙ্গে হিজবুল্লার প্রধান নেতা সৈয়দ হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল। এর আগে ঘটে পেজারে বিস্ফোরণ করে কয়েক শ’ হিজবুল্লাহ কর্মীকে খুনের ঘটনা। এরপরই নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রতিশোধ নেয় ইরান। যেখানে কোনো হতাহতের ঘটনা নেই।
১ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর দ্বিতীয় হামলায় ২০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল ইরান। ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ তথা লোহার গম্বুজ প্রযুক্তি ইরানের সব ক্ষেপণাস্ত্রকে হেলায় প্রতিহত করে। আসলে, ইরানের তরফে এটাই বার্তা ছিল যে, তাদের ইসরায়েলের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে- ইরানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি শেষ ইসরায়েলের। যে কোনো দিন শুরু হবে এই হামলা। এই হামলায় ইরানে কত প্রাণহানি ঘটে, এখন হয়তো সেটাও দেখে যেতে হবে গাজার মতোই।
বোমাবর্ষণ ও ড্রোন হামলা ছাড়াও ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে খতম করার নামে লেবাননের ১৫০ মাইল সীমান্ত ধরে স্থল অভিযান শুরু করেছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য- এই অঞ্চলে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করা এবং গত বছরের অক্টোবরে হামাস হামলার পর উত্তর ইসরায়েলে লেবানন থেকে আসা হিজবুল্লাহর লাগাতার রকেট হামলায় আশ্রয়চ্যুত ৬০ হাজার ইহুদিকে ঘরে ফিরিয়ে দেওয়া। ইসরায়েলি হামলায় গত এক মাসে লেবাননে লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে।
পশ্চিম এশিয়ায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েল যে চূড়ান্ত ‘লক্ষ্য’ এখন হাসিল করতে চায়, তার রূপরেখা ২৭ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘে দিয়ে এসেছেন নেতানিয়াহু। মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিনকে মুছে দিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েলের ছবি তিনি রাষ্ট্র সংঘে দেখিয়ে এসেছেন। ইসরায়েলের লক্ষ্য- ফিলিস্তিনীয়দের খাঁচার মধ্যে বন্দি করা এবং ইরানকে দুর্বল করা ও লেবানন-ইয়েমেন-ইরাক-সিরিয়ার প্রতিরোধের অক্ষটিকে ধ্বংস করা। হামাসের মতো হিজবুল্লাহ, হুথি, হাশাদ আল-শাবি ইত্যাদি সংগঠনকে ধ্বংস করা এবং আরব দেশগুলোর রাজতন্ত্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনও ইসরায়েলের কৌশলের অঙ্গ। ইসরায়েল এটা বিশ্বাস করে যে, এই যুদ্ধের সাফল্য তাদের চ্যালেঞ্জহীন আঞ্চলিক শক্তি করে তুলবে। ইসরায়েল যদি এই অঞ্চলের চ্যালেঞ্জহীন শক্তি হয়, তাহলে তেলসমৃদ্ধ এই অঞ্চলে সুরক্ষিত থাকবে মার্কিন স্বার্থ। নার্ভাস আরব রাজতন্ত্রগুলো অনুগত থাকবে মার্কিন শক্তির। সেই কারণেই গাজার ‘গণহত্যা’র শব্দ শোনার কেউ নেই মার্কিন মুল্লকে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যেভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। জোরদার শান্তি আন্দোলনের পক্ষে আক্রমণ বন্ধের জন্য আমেরিকা ও ইসরায়েলের পণ্য বয়কট আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। অন্তহীন হিংস্রতা ও বিপরীতে নিঃসীম নিস্পৃহতাকে ‘অবধারিত’ বলে কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আরেকটি কথা, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অবৈধ দখল এখনো মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের মূল কারণ। দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের কাঠামোর মধ্যে ফিলিস্তিনের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায়।
আপনার মতামত লিখুন :