ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

গণমাধ্যমের সিনা টানের এখনই সময়

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২৪, ০১:৪৫ পিএম

গণমাধ্যমের সিনা টানের এখনই সময়

মোস্তফা কামাল। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সামনের দিনগুলোয় কী হবে- তা ভবিতব্য। তবে, এখন পর্যন্ত দলীয় বলয়মুক্ত হওয়ার উচ্চাশা এবারের বিপ্লব ঘটানো বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। জনমের শিক্ষা হওয়ার পর পুলিশের মধ্যে আর কোনো দলীয় বাহিনী না হওয়ার অভিপ্রায়। দলবাজিতে ছারখার হওয়ার পর ব্যবসায়ীরাও এখন বলছেন আর দলান্ধ না হয়ে কেবল ব্যবসা নিয়ে থাকার। সাংবাদিকরা কী করবে?

বিগত দিনে দলকানা হওয়ার পরিণতিতে এখন এ মহান পেশাটির কিছু লোক পলাতক জীবনকে অনিবার্য করেছেন। তা কেবল ফেরারিদের জন্য নয়, গোটা পেশার জন্যই লজ্জা ও অপমানের। পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশান্তরী হয়েছেন। তার স্বজন-পরিজন, দলীয় নেতাকর্মীরা হয় পালিয়েছেন, নইলে এখানে-ওখানে ধরা পড়ছেন। জেলে ঢুকছেন। এটা তাদের পাওনা। কিন্তু, সাংবাদিকরাও কেন পালাবেন? মর্দে মদনের পর এখন কয়েদি হবেন? জবাব কমবেশি সবার জানা। শেখ হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। আবার ফুলেফেঁপে তাগড়াও হয়েছেন কিছু গণমাধ্যমকর্মী। আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের মতো কয়েক জায়গায় প্রেসক্লাবও আক্রান্ত হয়েছে। গায়ের বা মুখের জোরে অস্বীকার করা যাবে না এ সত্যতা। এ বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করে গণমাধ্যমকর্মীরা কি এখন নিজেদের সম্মান-ইজ্জত প্রতিষ্ঠায় আগোয়ান হতে পারেন না? মন চায় না যার যার জায়গা থেকে নিজের শিরদাঁড়া সোজা করতে। সেই চেষ্টা করতেও মানা? শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন অবসানের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৩-৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আহত অনেকে। কিছু ক্ষেত্রে সাংবাদিকেরা কেন আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা-পর্যালোচনা করা যায় না?

সেই আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি। সাংবাদিকতা কঠিন পেশা। পেশাদার ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় অনেক ঝুঁকি। তা জেনেই তো সাংবাদিকতায় আসা। সরকারের নিপীড়ন-নিগ্রহ ও ভীতিতে এবার সত্য প্রকাশ যে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কঠিন অবস্থায় না পড়তে বা সুবিধা হাছিলের মোহে সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ স্বৈরতন্ত্রের সহযোগী হয়েছে। ভাগেযোগে তেলতেলে হয়েছে। তাদের কয়েকজন ভিন্নমত দমনে শেখ হাসিনাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপবাদ ছড়িয়েছেন। তাদের আরও হয়রানির জন্য উসকানি দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন ও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনা, শাসকচক্রের নানা দুর্নীতি এড়িয়ে গেছেন। আড়াল রাখার চেষ্টাও করেছেন। এখন  প্রায়শ্চিত্য করছেন। নিজেরা ভুগছেন। ভোগাচ্ছেন বাদবাকিদেরও।

 শুদ্ধ হওয়া বা ভবিষ্যতে আর দলদাস না হওয়ার একটা চর্চা তারা এখনই শুরু করতে পারেন। উদ্যোগ নিতে পারেন তাদের প্রতিষ্ঠানের তদারকিব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে পারেন। হাত দিতে পারেন নিজেদের কোনো দলের খুচরা কর্মী হওয়ার রোগ সারানোর কাজে। একচেটিয়াতন্ত্রের সুযোগে লাগাম টানতে। এসবের একটা সুযোগ পার হচ্ছে এখন। সেল্ফ সেন্সর বা নিজে নিজে নিয়ন্ত্রিত না হতে সাংবাদিকদের আহ্বান জানানো হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের মন-মনন আগে থেকেই পরিষ্কার তথা ইতিবাচক। তার ওপর স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের কথা বলেছেন তার তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অন্যতম প্রধান আহ্বানও ছিল তার বন্দনা না করা, বিশেষ করে তার ছবি দিয়ে বৈজ্ঞাপনিক কায়কারবার না করার, যা আগের জমানায় চলেছে হরদম প্রতিযোগিতায়। বিভিন্ন মহলের কাছে তার এ বার্তা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য। আর সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার। সাংবাদিকদের দিক ঠিক করার একটি মোক্ষম বার্তা ও সুযোগও।

একটি দেশে গণতন্ত্র কতটা শক্তিশালী, তার উল্লেখযোগ্য সূচক হলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা? কিন্তু, এই স্বাধীন থাকার চেয়ে নিজেকে অধীনস্থ করে গোটা পেশাটিকে কলঙ্কিত করার একটি বাতিক সময়ে সময়ে দেখতে হয়েছে; ভুগতেও হয়েছে। তারা সংখ্যায় বেশি নয়, তবে, শক্তিতে বলীয়ান। ধারে-ভারে মারাত্মক। তাত্ত্বিক বা পুঁথিগতভাবে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। ইংরেজিতে ফোর্থ স্টেট। সেই অবস্থাটা বরবাদ করে গোটা গণমাধ্যমকে কলঙ্কিত করে নিজে তেলতেলে হওয়া গুটিকতক সাংবাদিকের দুষ্কর্ম আমাদের দেখতে হয়েছে। সরকারের নানা আইন ও বিধির বেড়াজালকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগোয়ান এই জীবেরা গোটা সাংবাদিক মহলকে দিকহারা করেছেন। সাংবাদিক নামের সঙ্গেই ‘দিক’ শব্দটা রয়েছে। সাংবাদিকদের এই ‘দিকটাও’ তারা কলঙ্কিত করেছেন। যার অনিবার্য পরিণতিতে গোটা সাংবাদিক পেশাটিই। সমাজের নানা স্তরে বাঁকা চোখের শিকার গণমাধ্যমকর্মীরা। গালমন্দ শোনার পাত্রও যেন তারাই এমনিতেই পেশাটি শারীরিক-মানসিকভাবে চরম ঝুঁকির। তারপরও এ পেশায় একবার জড়িয়ে গেলে আর ফেরার উপায় থাকে না। অন্য কোনো কাজে তারা আর মানানসই হতে পারেন না। তারপরও আইনি যন্ত্রণা ও অমর্যাদা তো রয়েছেই।

বিগত সরকারের সময় নানা আইন সংবাদমাধ্যমের ওপর খড়্গ হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আবারও মানইজ্জতের দিকে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে সাংবাদিকদের। এখন সাংবাদিকেরা এদিকে-ওদিকে না গিয়ে কোন দিকে কেবলামুখী হবেন, এটা তাদেরই বিষয়। সাংবাদিকতার নামে মোটাতাজা হওয়া দলকানা ছাড়া সবারই জানা, গত দশকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ক্যাজুয়ালটির শিকার ছিল গণমাধ্যম। রক্তক্ষয়ী জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লবপরবর্তী পর্যায়ে মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার সুযোগ এসেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে যেহেতু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখতে উদ্যোগী হতে পারেনি, তারা এখন কোন মুখে পেশাদার হবেন- এমন ইতস্ততের মাঝেও চাইলে কাজটি অন্তত শুরু করতে পারেন। পুরো দোষ কোনো সরকার বা মহলকে না দিয়ে নিজের কাছেও কিছু রাখা চাই। ভুল শিকার করে কান ধরে ওঠবসের দরকার করে না। একটু আত্মসমালোচনাই যথেষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাষ্ট্র পরিচালনার মতোই মিডিয়াকে করায়ত্ত করে ‘স্টিক অ্যান্ড ক্যারোট আপ্রোচ’ (লাঠির সঙ্গে গাজর)’ আখেরে নিস্তার দিতে পারেনি। একটি গোষ্ঠীকে হালুয়া-রুটিতে রেখে বাকিদের ভয় দেখিয়ে শেষতক চুপ রাখা যায়নি।

যার জেরে এই শাসন-তোষণ কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখা যায়নি। অনুগতরা শেষদিকে বন্দনা, গুণকীর্তনের বয়ান প্রচারের চেয়ে লুঙ্গি ড্যান্সে পালানোর গলি খুঁজেছেন। ক্ষমতার বড় ভাইরা পালানোর সময় তাদের নিয়েও যাননি। হিজ হিজ-হুজ হুজে যার যার মতো যে যেখানে পেরেছে আপনা প্রাণ বাঁচিয়েছে। অথচ তারা রাষ্ট্রের চতুর্থ খাম্বা। এই খাম্বা বা স্তম্ভের অপমানের ভাগিদার হতে হয়েছে মাঠে কাজ করা পেশাদার সাংবাদিকদেরও। লাজশরমে প্রিজারবেটিভ মাখা চম্পটওয়ালাদের কথা আলাদা। তাদের বাঁচতে পেরেই সন্তুষ্টি। বিষয়টি গোটা পেশার জন্য একটি ধাক্কা। এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার এখন এক সোনালি সময়। সেই রাস্তা করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। বলেছেন সরকারের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিতে। এখন সুযোগটি নেওয়ার পর্ব। বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতার সদ্ব্যবহারের সক্ষমতা ও সৎসাহসে ঘাটতির মাঝেও পেশাদার কমিটেড সাংবাদিকেরা তা অন্তত শুরুটা করতে পারেন। রাষ্ট্র মেরামতের সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যম পুনর্গঠন ও মানবসম্পদের গুণগত মানের পরিবর্তন না এনে উপায় নেই। শুরু হলে গণমাধ্যমের উন্নয়ন ও গবেষণাসংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর ভূমিকায় আসবে, সেই আশা ও বাস্তবতা অত্যন্ত বিদ্যমান। খাঁচায় পোষা পাখির মতো বেসরকারি গণমাধ্যম নতুন পাওয়া স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে শুরুতে একটু আধটু আছাড় খেলেও পরে অবশ্যই দাঁড়াবে। দিক খুঁজে নেবে।

গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে অনেক কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ অনেক কিছুর মধ্যে অবশ্যই গণমাধ্যমকে প্রাধান্য দিতেই হবে। নইলে অন্য সব সংস্কার ব্যর্থ হতে সময় লাগবে না। নিজ শাসিত পেশা ও ব্যবস্থা গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতাকে মর্যাদায় ফেরাতে না পারলে, রাজনীতির চোরাগলি থেকে রক্ষা করতে না পারলে গিরগিটির মতো রং পাল্টানোর বিমারি কোনো দিন সারবে না। চাটুকারিতা, মোসাহেবি, তোষামোদি, স্তাবকতা, পদলেহন-একটাও সাংবাদিকের কাজ নয়। পেটে ভাত না থাকলেও নামে তারা ‘মহান’। এই মহত্ত আসলে ব্যক্তির কাজে। পেশা মহান হতে পারে না। এমন অবস্থায় আর এদিক-ওদিক নয়, নিজের দিক এখন সাংবাদিকদের খুঁজতেই হবে। সামনের দিনগুলো উজ্জ্বল হোক। এর আগে দরকার ঔজ্জ্বল্যের নিয়ত করা। নিজেকে বদলানোর মাইন্ডসেট  ঠিক করা। চারদিকে এখন আলাপ কেবল সংস্কার নিয়ে। সংস্কারের আরেক অর্থ মেরামত, শোধরানো। আরেক অর্থ ভালো করা বা ভালো হয়ে যাওয়া। বাংলা প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, ‘ভালো হতে পয়সা লাগে না’। তা  হলে কী লাগে? লাগে ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলেই হয়ে যায়? না, কখনো কখনো ইচ্ছা থাকলেও ভালো হওয়া যায় না। মাত্রাহীন ভেজালে ভালো হওয়ার আর সময় থাকে না। বহু বছর পর  সেই সময়-সুযোগটা ধরা দিয়েছে সাংবাদিকসহ আরও নানা পেশার জন্য। 

 

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরবি/জেডআর

Link copied!