ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

ছাত্র রাজনীতির গৌরব ফিরে আসুক

শায়রুল কবির খান

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০৪:৫৮ পিএম

ছাত্র রাজনীতির গৌরব ফিরে আসুক

শায়রুল কবির খান। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সূচনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন থেকে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ছাত্র-শিক্ষক সমাজের অগ্রগণ্য সব সময় বিবেচিত হয়েছে। যখনই দেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়েছে তখনই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন হয়ে উঠেছে আন্দোলন মুখর। ছাত্র রাজনীতি ও গণতন্ত্রচর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনুধাবন করতে হলে প্রথমেই আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংগ্রাম সম্পর্কে জানতে হবে। গণতন্ত্র এক ধরনের সরকারব্যবস্থা। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সমাজব্যবস্থা। সবার আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে গণতন্ত্র। জনগণের জীবনে রচনা করে এক বলিষ্ঠ জীবনবোধ।

দুর্ভাগ্যবশত রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেনি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে গণতন্ত্রহীনতা ও এক ধরনের শূন্যতা। সেই শূন্যতা গিয়ে পড়ছে সমাজের অপেক্ষাকৃত অগ্রসরমান ছাত্ররাজনীতির কেন্দ্রভূমি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ভূমিকা সুস্পষ্ট।

প্রতিটি সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকেরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে মধ্যবিত্ত মুসলমান অনেক ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ’৪৮-৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের গণতন্ত্রের জন্য যে হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসা ছিল তা এই জাতি কখনো ভুলবে না। স্বৈরাচার আইউবের  বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ গড়ে তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ১৯৬৬ সালের ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক আইউবের পতন ঘটে ছাত্র সংগ্রামের হাত ধরেই। ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইয়াহিয়া পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এর পেছনেও ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। ৬ দফা ও ১১ দফার পরিবর্তে এক দফার দাবিতে তারাই বর্তমান বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপনের অগ্রনায়ক। ১৯৭১ সালে ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়। তার পরের ইতিহাস প্রায় সবার জানা। বহু দিনের গণতান্ত্রিক চেতনার আদর্শে লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের গণতন্ত্র নির্বাসিত হয় সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে।

একদলীয় বাকশালের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই জাসদ, ছাত্রলীগসহ বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদে সংগঠিত হয়। ‘৬০-এর দশকে দেশজুড়ে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ‘৮০-এর দশকে জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তোলে। এ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়। গণতন্ত্রের সূচনালগ্নে বিরোধী দলের সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতার ধারাবাহিকতায় প্রায় এক যুগের মধ্যে এক গভীর ষড়যন্ত্রে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি জেনারেল মঈন ও ফখরুদ্দীনের জরুরি আইনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ‘৯০-এর দশকের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের অভাবে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের শক্তি ও সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। ফলে মঈন-ফখরুদ্দীনের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চার পথ দেখাতে পারেনি। তৈরি করতে পারেনি মেধাবী ছাত্র নেতৃত্ব। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে ওঠেনি সংকটকালে ন্যায়পরায়ণ এবং সহনশীল রাজনীতিবিদ। জাতীয় মূল্যবোধকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি গণতন্ত্রের স্বর্ণালি উপত্যকায়।

তাই এবার এই দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলতি বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়। এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা হওয়া প্রয়োজন আরও প্রাণবন্ত, আরও বলিষ্ঠ।অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছাত্রদের নিয়ে উচ্চাভিলাষী কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা না করে আবেগের পরিবর্তে যুক্তি প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

বৈরীভাবের পরিবর্তে সুস্থ প্রতিযোগিতার উৎস বৃদ্ধি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির পথকে আরও সুগম এবং মসৃণ করে তুলতে হবে। এ সমাজের সচেতন নাগরিকদের এমন প্রত্যাশা পূর্ণ করে সরকারের সংস্কার উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতিকর্মী
 

আরবি/জেডআর

Link copied!