ঢাকা সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

ক্ষমতার সখা হলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়

খান মো. রবিউল আলম

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০৪:৫১ পিএম

ক্ষমতার সখা হলে সাংবাদিকতা মর্যাদা হারায়

খান মো. রবিউল আলম। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মিডিয়া কি শাসনের অংশীদার হতে পারে? কিংবা সরকারের সব কর্মকাণ্ডের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে? মিডিয়া ও সরকার যদি এক লাইনে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে কি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয় না? স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা, নির্বতনমূলক আইন বাতিল, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে। সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে প্রধান উপদেষ্টা ভুল ধরিয়ে দিতে গণমাধ্যমকে সোচ্চার থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। আরও বলেছেন, তিনি সত্যিকার অর্থে সক্রিয় (ভাইব্র্যান্ট) গণমাধ্যম চান, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। আর এই সক্রিয় গণমাধ্যমের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তাই করবেন। প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

অর্থাৎ দেশে এমন গণমাধ্যম সংস্কৃতি চালু হয়েছিল যেখানে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ওয়ার্চ করার চেয়ে কোলে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। এ কোল হলো ক্ষমতার কোল। ক্ষমতার নৈকট্য। ক্ষমতাত্যাগী আওয়ামী লীগ সরকার একটি অনুগত মিডিয়া সেক্টর গড়ে তুলতে চেয়েছিল। মিডিয়ার একটি বড় অংশ পার্টনার বনে গিয়েছিল। সরকারি ভাষ্য ও মিডিয়ার বয়ানের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

রাজনৈতিক সাংবাদিকতা হলো পক্ষদুষ্ট, শাসনের উপযোগী এক ধরনের সাংবাদিকতা, যা থেকে অর্থনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক সুবিধা চুঁইয়ে পড়ে। সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক-সর্বস্বতা পাঠক প্রতারিত হয়। পাঠকের জানার অধিকার সংকুচিত হয়। বাধ্যতামূলকভাবে খবর পড়তে এবং সংবাদ দেখতে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের বাধ্যতামূলক মনোভঙ্গি হলো ফ্যাসিস্ট মনোভঙ্গি। জোরজবরদস্তিমূলক চর্চা।

ভিজ্যুয়াল ভায়োলেন্স ছিল বিগত আওয়ামী লীগ শাসনের এক ভয়াবহ দিক। এ ভায়োলেন্স কেবল মিডিয়া মুদ্রণে ঘটেনি, ঘটেছে পোস্টার, ব্যানারে, প্রচার-প্রচারণা, বিজ্ঞাপন, ভাষণ, বড় বড় বিল্ডিং বর্ণিল সাজে ও ফেস্টুনে। অনেক অপ্রয়োজনীয় উপস্থিতি জনগণ দেখেছে। এ ছিল এক ধরনের বিশেষ মনোভঙ্গি, বিশেষ প্রদর্শন। এ প্রদর্শনবাদ এক অসহ্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সবকিছু টক্সিক হয়ে পড়েছিল। সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের বড় একটা অংশ ছিল সরকারি বয়ানের ফেরিওয়ালা, তল্পিবাহক 
শাসকগোষ্ঠী স্বার্থের উপযোগী সংবাদপ্রবাহ চালু করেছিল। মিডিয়া সে সখ্যে ছিল নিমজ্জিত। সরকারি বয়ান ও মিডিয়ার বয়ানের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। স্টেবলিস্টমেন্টের পক্ষে সাফাই গাওয়া ছিল বড় কাজ।

কারণ, এসব মিডিয়ার মালিকানা, লাইসেন্সিং ছিল আওয়ামী-সমর্থিত ব্যবসায়ী ও অনুগতদের হাতে। শাসকগোষ্ঠী শাসনের উপযোগী মিডিয়া মার্কেট গড়ে তুলেছিল। মিডিয়ার এ ক্ষমতাকেন্দ্রিক আচরণ মানুষ গ্রহণ করেনি। কারণ, সাধারণ মানুষ কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বুঝেছে ক্ষমতা ও মিডিয়ার সম্পর্ক জনস্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। 
ক্ষমতার সঙ্গে মিডিয়ার সম্পর্ক নিয়ে চারটি মডেল রয়েছে। অ্যান অ্যানাইলাসিস অব দ্য মিডিয়া অ্যান্ড গভর্নমেন্ট রিলেশন্স প্রবন্ধে ইউসুফ ইয়ুকসেল এ চারটি মডেল নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর প্রথমটি হলো ‘হোজিমনি বা কর্তৃত্ববাদী মডেল’। এর আওতায় মিডিয়া কর্তৃত্ববাদী শাসনের বয়ান পুনরুৎপাদনে এবং শাসনের উপযোগী জনমত গঠন করে। ইতালিয়ান তাত্ত্বিক অন্তোনিও গ্রামসি এ তত্ত্বের প্রবক্তা।

আরেকটি তত্ত্ব হলো প্রচারণা মডেল। অ্যাডওয়ার্ড এস হারম্যান ও নোয়াম চমস্কি ও তাদের ম্যানিফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ম্যাস মিডিয়া গ্রন্থে এ তত্ত্ব তুলে ধরেন। এখানে রাষ্ট্রীয় মেশিনারিজ সংবাদপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে কীভাবে নানা ধরনের ঝাঁকুনি ব্যবহার করে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠী সংবাদ ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের উপযোগ জনমত বিনির্মাণ করে।

ইনডেক্সিং অ্যাপ্রচ হলো আরেক মডেল যার প্রবক্তা এল ডব্লিউ বেনেট। এ তত্ত্বের মূল কথা হলো সমাজে এলিট বা রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে কোনো ইস্যুতে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে মিডিয়া কাভারেজের বিষয় ইস্যু বা নীতিকে সমর্থন করতে থাকে।

মিডিয়ার ফ্রেমিং আরেকটি তত্ত্ব। মিডিয়া একটি পরিস্থিতিকে কীভাবে ফ্রেম বা কাঠামোবদ্ধ করে জি ব্যাটসন তার ওপর আলোকপাত করেছেন। গত আওয়ামী শাসনামলে দেখা গেছে মিডিয়ার ফ্রেম মূলত চারটি মূলভাবগত পরিক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল; এগুলো হলো মুক্তিযুক্ত, বঙ্গবন্ধু, উন্নয়ন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মিডিয়ার ফ্রেমের একটি বড় ক্ষেত্র উঠছে সংস্কার ইস্যু।

কথা হলো শাসকগোষ্ঠী আরোপিত ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকলে মিডিয়া তার স্বতন্ত্র, পেশাদারিত্ব ও পরিচয় হারিয়ে ফেলবে। মিডিয়ার উচিত তার মতো ফ্রেম বানানো। কোনো আরোপিত ফ্রেমের ভেতর না পড়া। এটা করতে পারলে মিডিয়া বৈচিত্র্যময় কণ্ঠ তুলে ধরতে পারবে। মিডিয়া সব ফ্রেমের বাইরে এসে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথ রচনা করতে হবে। কারণ, ক্ষমতার সঙ্গে মিথোজীবিতা নয়, পেশাদারিত্ব, নৈতিকতা ও মান পারে সংবাদিকতাকে বাঁচাতে। এ ছাড়া উন্নত কোনো বিকল্প নয়। 
মোদ্দা কথা হলো, ক্ষমতার সঙ্গে থাকা, ক্ষমতার কাছকাছি থাকার অভ্যাস সাংবাদিকতার সঙ্গে সাজুয্যময় নয়। এ দেশের সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে সেই ধরনের অভিব্যক্তি বারবার প্রকাশিত হচ্ছে।

একজন প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিক কেন আগ বাড়িয়ে সরকারের সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাগ্রতা প্রকাশ করতে যাচ্ছেন, সেটা সমস্যাপূর্ণ মনে হচ্ছে। 
ফেস্টিস শাসনামলে নিকট অতীতে পাঠক সাংবাদিক নেতাদের এমন অভিব্যক্তি দেখা গেছে। গত ২৪ জুলাই ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভায় দেশের একজন প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, ‘শেখ হাসিনার সঙ্গে আছেন, প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত’ (সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ জুলাই ২০২৪)। এ বক্তব্য সাংবাদিকদের সঙ্গে ক্ষমতার পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। এডিটরস গিল্ডের উদ্যোগে এই আয়োজনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও হেড অব নিউজ উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী শাসনের বাস্তবতা ও আজকের পরিস্থিতি এক নয়। তবুও গোয়াল পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। একটি বিশেষ পরিস্থিতি চলছে। ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, স্বচ্ছতা ও  জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন দায়িত্বশীল ও পেশাদারি সাংবাদিকতা।

সাংবাদিকদের কাছ থেকে জনগণ আশা করে নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ। দেশীয়, আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ। দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার, আইনশৃঙ্খলা, আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, জননিরাপত্তার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা দরকার। সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় এজেন্ডা। সংস্কার কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হবে।

নতুন বাস্তবতায় মিডিয়ার প্রকাশভঙ্গি নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে। কারণ, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সবাই নতুন বাস্তবতার ভেতর ঢুকেছে। চারদিকে নানা ধরনের অস্পষ্টতা। আগামীর বাংলাদেশের গতিপথ নিয়ে অস্পষ্টতা কাটেনি।

কী রসায়নে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি রচিত হবে, সবার জন্য সহনশীল, মর্যাদাসম্পন্ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি আধুনিক রাষ্ট্রের গতিপথ নির্মিত হচ্ছে কি না, সেগুলো মিডিয়ার পরিবীক্ষণের মধ্যে থাকতে হবে। প্রশ্ন জারি রেখে মিডিয়াকে এগোতে হবে। এখানে ক্ষমতার প্রতি সমর্থন বা অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। ক্ষমতার অংশ হতে গেলে মিডিয়া জনগণের আস্থা হারাবে, চোরাবালিতে পা দেবে। গণমাধ্যম একরৈখিক কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বলা হয় গণমাধ্যমের কোনো ধরনের বিশ্বাস বা প্রিজুডিস থাকতে নেই। যদি কোনো প্রিজুডিস থাকে তবে তা সত্যনিষ্ঠতা ও পাঠক-দর্শকদের প্রতি দায়বদ্ধতা।

 

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
 

আরবি/জেডআর

Link copied!