ঢাকা শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

হাওর উন্নয়নে প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৯:০৭ এএম

হাওর উন্নয়নে প্রয়োজন মহাপরিকল্পনা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

হাওর বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল জলরাশি। হাওরের শিল্প-সংস্কৃতি আজ অনেককেই বিমুগ্ধ করছে। দিন যতই যাচ্ছে, হাওরের প্রতি মানুষের গভীর টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখন ভ্রমণের জন্য হাওর অঞ্চলকে বেছে নিচ্ছেন। এখানে তাই পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তা কতটা কাজে লাগাতে পারছি সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন?

হাওর অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই ৭টি জেলার হাওর অঞ্চলকে বুঝায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সমুদ্রবক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওর। হাওর অঞ্চল মোট ৩৭৩টা। এসব হাওরের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, নেত্রকোনায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। হাওর বেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩ হাজারের অধিক জলমহাল, যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওর অঞ্চল ১০-৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওরাঞ্চলে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের সমারোহ দেখা যায়। মানুষের মন খুশিতে নেচে ওঠে এ সময়।

হাওর দূরচিত্রে দেখতে বাটির মতো মনে হয়। প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন মানুষের বাস। মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, যাতে বছরে ধান উৎপাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন।

একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা-হাওর উন্নয়নের রোডম্যাপ হিসেবে এতে সম্ভাব্য সব মূল বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনায় কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও। মনিটরিং করবে বোর্ড, কিন্তু তাদের রয়েছে সীমিতসংখ্যক লোকবল। হাওরের এ মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নে বোর্ডকে শক্তিশালী করা একান্ত জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি জিআইএস ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, মূল্যায়ন এবং ছয় ধাপে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়।

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ছাড়া বর্তমানে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। কৃষি প্রযুক্তি আমাদের শ্রমের লাঘব, কম উৎপাদন খরচ, অধিক ফলন, কম অপচয়, বেশি লাভ ও পুষ্ট শস্যদানা উপহার দেয়। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। হাওর এলাকার ১৬টি উপজেলায় গভীর পানিতে বোনা আমন ধান চাষ হয়। এসব জলাধান মাছের খাবার ও আশ্রয় জোগায়। ধান চাষের পর এ জমি পতিত থাকে। কিছু কৃষক এসব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে উচ্চমূল্যের  স্বল্পজীবী, অধিক ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ধানের চেয়ে ফল, সবজি, মসলা, তৈল ও ডাল জাতীয় শস্য চাষ অধিক লাভজনক। তবে এ মহাপরিকল্পনায় ধানের বীজ উৎপাদনের স্বতন্ত্র প্রকল্প থাকা অপরিহার্য।

আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে কৃষকদের চাষের পরামর্শ দেওয়া হয়। জলবায়ু, ভূমির গঠন, শ্রেণিবিন্যাস করে ভূমির সব রকমের ব্যবহরের সম্ভাব্যতা যাচাই, জমির উর্বরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদ, আপদ, বাজার, যোগাযোগ সবই বিবেচনায় নিয়ে ডাটা বেইস করা ও শস্য বিন্যাস করা হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করে ফসল উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবনে প্রতি উপজেলা হতে কৃষক নিয়ে কৃষককে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।

সমন্বিত শস্য ব্যবস্থাপনায় অনবায়নযোগ্য সামগ্রীর ব্যবহার সীমিত করে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, অপচয় ও দূষণ কমিয়ে অধিক ফসল উৎপাদনই মূল লক্ষ্য। শস্য আবর্তন, সঠিক জাত প্রযুক্তি, অকৃত্রিম বৃহত্তর ব্যবহার হ্রাস, ভূমির ঢালু ও বন্য প্রাণীর আচার অক্ষুণ্ন রাখা হবে। হাওর এলাকার ১৬টি উপজেলার পাহাড়ি ঢালু ভূমিতে সুগন্ধি ও ওষধি গাছ-আগরের চাষ ও উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সারা বছরব্যাপী বসতবাড়িতে সবজি, মাশরুম, ডাল, মসলা, ফলফলাদি চাষ বৃদ্ধির করে পুষ্টির জোগান এবং আয় বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা। হাওর মহাপরিকল্পনার সমন্বিত উদ্যোগ হিসাবে রয়েছে নদী খনন। খননকৃত মাটি দিয়ে উঁচু ভিটা তৈরি করাসহ মোট দুই হাজার গ্রামের ভিটায় তা বাস্তবায়ন করা হবে। দশ হাজার কৃষক বাছাই করে প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে সার, বীজ, কীটনাশক  দিয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হবে। পুকুর খনন করে আরও বেশি পরিকল্পিত গ্রাম সৃজন করে আধুনিক সুবিধা সংবলিত বহুতল বিল্ডিং, সবজি, মাছ, ফল গাছ, গবাদি, হাঁস-মুরগির পালনের মাধ্যমে অনেকগুণ আয় বৃদ্ধি সম্ভব।

বর্ষায় হাওরে শুকনো জমি দুষ্কর, সবজিও দুর্লভ বটে কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল জলজ উদ্ভিদ প্রচুর। হাওরে গ্রামের পাশে কিছু জায়গায় পানির প্রবাহ বা ঢেউ থাকে না। সেখানে এগুলো ব্যবহার করে ভাসমন সবজিতে লালশাক, পুইশাক, করলা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসাসহ বিভিন্ন মসলা জাতীয় ফসলের আবাদে উদ্বুদ্ধকরণ। 

উন্নত, অধিক ফলনশীল বোরো, আমন ধানের, সবজি, ডাল, তৈল, মসলার বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। কৃষক সংগঠন, উৎপাদক ও ব্যবসায়ী, পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলা হবে। এ সংগঠনের মাধ্যমে পাওয়ার টিলার, ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচপাম্প প্রদান করার পরিকল্পনা। ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি ও অকৃষিজীবী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য বাজার ঘর তৈরি; নিয়মিত মূল্য ঘোষণা, মাননিয়ন্ত্রণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, সংরক্ষণ।

বাংলাদেশের জলাভূমির মারাত্মক সমস্যা এখন দাঁড়িয়েছে সেডিমেন্ট। এটা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের নেই, তবে ম্যানেজ করার সুযোগ আছে। উজান থেকে ও পাহাড় থেকে পানি নেমে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে সেডিমেন্ট, বছরে এক বিলিয়ন টন সেডিমেন্ট আসায় হাওর, জলাভূমি ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই জলাধারগুলোর প্রধান কাজ হলো, এলাকার মরুকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে হাওরের নাব্য সারা বছরের জন্য বাড়ানো যায়। মাটি উত্তোলন করে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় আবার বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। জলাভূমির নাব্য বাড়াতে পারলে সারা বছর মাছ চাষ করে ৬-৭ গুণ বেশি আয় করা সম্ভব হবে ফলে জিডিপির আকার বড় হবে, একইসঙ্গে সমাজে মানি ফ্লো তৈরি হবে।

হাওরে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা সম্ভব তাতে আমাদের মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বেড়ে যাবে। পুষ্টি চাহিদা মিটবে এবং মিঠা পানির মাছ রপ্তানিও করা যাবে। হাওর ও জলাশয়ে ১০০ কোটি করচ গাছ লাগনো যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে রাতারগুল পর্যটন এলাকার ন্যায় সব হাওর রাতারগুল হতে পারে। গাছের গোড়ায় মাছ আশ্রয় নেবে এবং গাছের উপরে পাখি আশ্রয় নিতে পারবে। গাছগুলোর শিকড় বাঁধ কিংবা মাটি ক্ষয় হতে রক্ষা করে। কার্বন এমিশন ব্যাপকহারে কমে আসবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক দেশীয় প্রজাতি হিজল তমাল গাছও লাগানো যেতে পারে।

হাওর ও জলাভূমিতে পর্যটনের ব্যবস্থা করা যায়। মানুষ যেখানে দুই ঘণ্টার বেশি থাকে সেখানে বাথরুম থাকতে হবে। যেখানে তিন ঘণ্টার বেশি থাকার প্রয়োজন হবে সেখানে খাবার হোটেল থাকতে হবে। কমিউনিটি বেইজড পর্যটন পরিচালনা করা যেতে পারে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অথবা উপজেলা পরিষদ দেখভাল করতে পারে এবং তাদের আয়ও হতে পারে। বাড়িতে ভাড়া সিস্টেমে পর্যটক রাখা যেতে পারে একই সঙ্গে পর্যটকদের খাবার সরবরাহও করা যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অর্থ উপার্জন করতে পারে আবার পর্যটনে তাদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ দুটোই বাড়বে।

হাওরের ৩৭টি উপজেলাকে সংযোগ করে ১০০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলে মানুষজনের মবিলিটি বাড়বে অপরদিকে পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যবে। বাংলাদেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নহে। বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেশি, ধুলাবালি বেশি, শব্দদূষণ বেশি, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা মারাত্মক দুর্বল। এর চেয়ে বেশি খারাপ মানুষের জীবন যাত্রার মান। ভারত, চায়না, নেপাল থেকে সেডিমেন্ট গড়িয়ে এসে আমাদের হাওর ও নদ-নদী ভরাট করে চলেছে। এজন্য নিয়মিত মাটি ড্রেজিং করে হাওর ও নদ-নদী সারা বছর নাব্য রাখা প্রয়োজন।

সুন্দরবন এলাকা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকোসিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। টাংগুয়ার হাওর ও হাকালুকি হাওর প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। হাওরের করচের তেলে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্পমেশিন চালানো, পাওয়ারট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল- জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়।

করচের খৈল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। করচের খৈল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এ ছাড়াও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খৈল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। হাওরের কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ¦লার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীরতায় কালো মাটি পাওয়া যায়। এ কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বালে।

হাওর এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্র্যের এক অপার লীলাভূমি। হাওরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। একদিন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। এখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন মনোরম হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা প্রয়োজন। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাওরের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হবে।

আরবি/জেআই

Link copied!