ঢাকা শনিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪
দ্বিতীয় পর্ব

বিকল্পের সন্ধানে মুক্তনাটক আন্দোলন

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৪, ২০২৪, ০৩:৩৯ পিএম

বিকল্পের সন্ধানে মুক্তনাটক আন্দোলন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত কয়েকটি নাট্য সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে রাকসু ভবনে অনুষ্ঠিত তিন দিনের ওই কর্মশালায় নতুন আঙ্গিকে নাট্য নির্মাণের ধারণা তুলে ধরেন মামুনুর রশীদ। এ বিষয়ে ব্যাপক মতবিনিময়ের মাধ্যমে কিছু নতুন কর্মপন্থাও নির্ধারিত হয় সেই কর্মশালায়। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দলের কর্মীরা নতুন এই কর্মপন্থার প্রতি আগ্রহ না দেখালেও অনুশীলন নাট্যদল অতি দ্রুত এই কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। কর্মশালা শেষ হওয়ার পরও দলটি আরণ্যক নাট্যদল বিশেষ করে মামুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখে এবং কর্মশালা পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তনাটক দল’ গঠন করে নতুন এই কর্মপরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি কর্মীবাহিনী গড়ে তোলে। এতে আরণ্যক নাট্যদলও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনুশীলন নাট্যদলের সঙ্গে যৌথ কর্মকৌশল প্রণয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ঠিক হয় প্রাথমিক পর্যায়ে তিন থেকে চারজনের একটি করে দল গ্রাম পর্যায়ে নিজেদের পরিচিত এলাকায় কাজ শুরু করবে এবং সেই কাজের ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

প্রাথমিক পর্যায়ে চলনবিল অঞ্চলের কতৎকান্দী (নিলাঞ্জন মুক্তনাটক দল), সিরাজগঞ্জে উল্লাপাড়ার গ্রাম কানসোনা, সিলেটের দেউন্দি চা-বাগানের শ্রমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোজনালয় শ্রমিকসহ আরও কয়েকটি এলাকায় কাজ শুরু করা হয়। গ্রামে পালাগান হয়, যাত্রা হয়, অনেক গ্রামে চৌকি বা খাট ফেলে উঁচু ভায়াস তৈরি করে শাড়ি ঝুলিয়ে উইং তৈরি, পেছনে ড্রপসিন ঝুলিয়ে প্রসেনিয়াম ঢঙে নাটকও মঞ্চায়ন হয়। একদল আয়োজন করেন, আরেকদল দর্শক হয়ে তা দেখেন। একদল মঞ্চে অভিনয় করেন আর একদল দর্শক হয়ে বাহবা দিয়ে চলে যান। আয়োজক বা অভিনয়-শিল্পীদের সঙ্গে সংযোগ তেমন ঘটে না। পালা বা যাত্রা এবং নাটক লেখার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের সঙ্গে তো দর্শকের প্রত্যক্ষ সংযোগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এই অবস্থা যখন চলে আসছিল দীর্ঘকালব্যাপী তখন মুক্তনাটক কর্মীরা এক নতুন ধারণা নিয়ে গ্রামের আয়োজক-দর্শকের কাছে উপস্থিত হন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তিন থেকে চারজনের এক একটি দল গ্রামে গিয়ে নতুন কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করবেন। কর্মীরা সেভাবে গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হন। সানন্দে তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নেন গ্রামবাসী। গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যারা কৃষি জমিতে কামলা খাটেন, কেউ প্রান্তিক চাষি, তাঁত বুনেন কেউ, কেউ স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বিদ্যার্থী এদের মধ্যেই উৎসাহ বেশি লক্ষ্য করা যায়। সবাই দিনে কাজ করেন বলে সন্ধ্যার পর শুরু হয় স্থানীয় কোনো স্কুল বা বাড়ির উঠোনে সবাইকে সমবেত করে নতুন ধারণা উপস্থাপনের কাজ। ওই সময়ে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছানি। হারিকেনের আলোয় মুক্তনাটক কর্মীরা আগ্রহী শত মানুষের কাছে তাদের ধারণা তুলে ধরেন। গ্রামের মানুষ যা ভাবেননি আগে, এমন কথা অবাক হয়ে শুনতে থাকেন গভীর রাত পর্যন্ত।

আরও পড়ুন: বিকল্পের সন্ধানে মুক্তনাটক আন্দোলন (প্রথম পর্ব)

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এই নতুন ধারণার মূল কথাগুলো কী? অথবা এভাবেও প্রশ্ন করা যায়, মুক্তনাটক কর্মীরা গ্রামের মানুষকে কী বললেন? তাদের বলা হলো, আপনারা আপনাদের সমস্যা নিয়ে নিজেরাই নাটকের বিষয়বস্তু ঠিক করবেন। বিষয়বস্তু উপস্থাপনে অভিনেতা হিসেবে অংশ নেবেন আপনারাই এবং দর্শকও হবেন আপনারাই। এর অর্থ হলো- এই ধরনের নাট্যনির্মাণ ও তা উপস্থাপনের সব পর্যায়ে যুক্ত থাকবেন সংশ্লিষ্ট গ্রামের মানুষই। যারা তাদের কাছে এই ধারণা উপস্থাপনের জন্য গেছেন তাদের কাজ হবে পেছনে থেকে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ করা। এভাবে শুরু হয়ে যায় নাট্যনির্মাণ প্রক্রিয়া। প্রথমে স্থানীয় সমস্যাগুলো সবার কাছ থেকে শোনা হয়। সেসব সমস্যা থেকে উপযুক্ত এক বা একাধিক সমস্যা নিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা প্লট দাঁড় করানো হয়। পরের দুদিন চলে মহড়া এবং চতুর্থ দিন নতুন আঙ্গিকে নির্মিত এই নাট্য সন্ধ্যার পর দর্শকের মুখোমুখি হয়। সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো, এই নাটকের কোনো পাণ্ডুলিপি নেই। ইমপ্রোভাইস করে বা তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনা রীতিতে নির্মাণ করা হতে থাকে এই নাটক। গ্রামে যারা যাত্রা, নাটক, পালাগান, পুঁথি-পাঁচালী পাঠের সঙ্গে যুক্ত তারাসহ অন্যান্য যুবকরা মহড়ার সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আকর্ষণীয় সংলাপ যুক্ত করে সাবলীল গতিতে ঘটনাকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হন। স্থানীয় সমস্যাভিত্তিক ঘটনা হওয়ায় এবং নিজেদের পরিচিত মানুষ এই নাট্যে অংশগ্রহণ করায় অভিনয়ের সময় দর্শকের মাঝে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। পঞ্চাশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ব্যাপ্তির এই নাট্যের অভিনয় শেষে দর্শকের মতামত আহ্বান করা হয়। এতে তাদের উৎসাহ আরও বেশি বাড়তে থাকে। অধিকাংশ স্থানে প্রথম মঞ্চায়নের পরে দর্শকদের মতামতের ভিত্তিতে অনেক সংযোজন-বিয়োজন করে পরবর্তী মঞ্চায়নের আয়োজন করা হয়। এমন কি প্রথম মঞ্চায়নের দিনের অনেক আগ্রহী দর্শকও দ্বিতীয় বা তৃতীয় মঞ্চায়নে অভিনেতা হিসেবে যুক্ত হতে থাকে।

এক্ষেত্রে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় অবস্থিত কানসোনা গ্রামের অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে। লেখকের সঙ্গে ওই গ্রামে কাজ করতে গিয়েছিলেন অনুশীলন নাট্যদলকর্মী তপন দাশ (দৈনিক সমকাল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে যিনি পরবর্তীতে অবসর নেন) ও রেজাউল করিম (বর্তমানে সরকারি কলেজের অধ্যাপক)। কাজটি তিন দিন ধরে কানসোনা গ্রামে করা হলেও চতুর্থ দিন নাট্যের প্রথম মঞ্চায়ন হয়, স্থানীয় কৃষকগঞ্জ বাজারে। সন্ধ্যার পর বাজারের খোলা চত্বরে মঞ্চায়নের পর আশপাশের গ্রামের দর্শকরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেন। সেই মতামতকে গ্রহণ করে ওই কৃষকগঞ্জ বাজারেই পরদিন দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হয়। প্রথম মঞ্চায়নের দর্শকেরা বুঝতে পারেন ওই নাটক বাইরের কারও লেখা নয়, এ তাদেরই নিজস্ব ভাবনা ও অংশগ্রহণের ফসল, যা অতীতে কখনো তারা দেখেননি। সেই অভূতপূর্ব এবং সাড়া জাগানো ঘটনা কোথাও লেখা হয়নি, প্রচার পায়নি তেমন, কিন্তু তা মুক্তনাটকের চলার পথে ছিল মাইলফলক। কেবল কানসোনা নয়, চলনবিল এলাকার করৎকান্দি, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ভোজনালয় শ্রমিকদের নিয়ে গড়ে তোলা দলসহ অন্যান্য দলের অভিজ্ঞতাও একই রকম। করৎকান্দি গ্রামের মুক্তনাটক নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং মামুনুর রশীদ। সেখানে বাড়ির উঠোনে প্রথম মঞ্চায়নের পর ঠিক হয় পরের দিনের মঞ্চায়ন হবে স্থানীয় নওগাঁ বাজারে।

প্রথম মঞ্চায়নের রাতে দর্শকদের পক্ষ থেকে বেশকিছু সংযোজনের অনুরোধ আসে। একইসঙ্গে তাদের অনুরোধ ছিল পরের দিনের মঞ্চায়নে যেন মামুনুর রশীদ ও এই নিবন্ধকার অভিনয় করেন। পরের দিন নওগাঁ বাজারে মঞ্চায়ন হয় বিকেল বেলায়। দর্শকদের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই মঞ্চায়নে মামুনুর রশীদ এবং নিবন্ধকার মঞ্চে ওঠেন। বলাবাহুল্য যে, দর্শকদের কাছে এই অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই নতুন এবং উৎসাহব্যঞ্জক। ফলে তাদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এসব অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে রংপুরের পাটগ্রাম, সৈয়দপুর, নীলফামারী ও পাবনার চাটমোহরসহ আরও অনেক স্থানে মুক্তনাটক দল গড়ে ওঠে। কথা ছিল যেসব স্থানে মুক্তনাটক দল গড়ে তোলা হবে সেই গড়ে উঠা দলগুলো নিজ উদ্যোগে আশপাশের গ্রামে নতুন দল তৈরি করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিকল্পনা সফল হয়। মুক্তনাটক সংগঠিত করার জন্য যে তিন-চারজনের দল গ্রামে যেতেন, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে প্রধানত তাদের ভূমিকা হবে সমন্বয়ক ও নিয়ন্ত্রকের। তারা পূর্ব থেকে কোনো বিষয়বস্তু বা আঙ্গিক মাথায় নিয়ে যেতেন না। স্থানীয় পরিস্থিতি, অংশগ্রহণকারীদের মতামত ও তাদের নিজস্ব যোগ্যতা ও পারদর্শিতাকে বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতেন তারা। মুক্তনাটকের প্রাথমিক পর্যায়ের এই কাজগুলো হচ্ছিল গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এই সময়ে স্বৈরশাসক এরশাদের দুঃশাসন দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রকে গ্রাস করে ফেলেছিল।

ফলে লক্ষ্য করা যায় থানা সদর পর্যায়ে মুক্তনাটকের জন্য সবার মতামতের ভিত্তিতে যেসব কাহিনি নির্বাচন করা হতো, মোটা দাগে তার বিষয়বস্তু স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আবার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বারদের দুষ্কর্ম বা প্রভাবশালী মাতবর মোড়লদের দৌরাত্ম্য হয়ে উঠতো মুক্তনাটকের বিষয়বস্তু। প্রায় প্রতিটি কর্মএলাকায় দেখা যেত স্থানীয়ভাবে যারা যাত্রা, বাউলগান, পালাগান, কীর্তন, কবিগান, সঙ, পুঁথি-পাঁচালী পাঠের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যারা বাঁশি, বাংলা চোল বা দোতারা, একতারা বাজাতে পারেন তারা সহজেই অতি উৎসাহ নিয়ে মুক্তনাটকের সঙ্গে যুক্ত হতেন। আর ঐতিহ্যবাহী বাংলানাট্যের এসব শক্তিশালী ও জনপ্রিয় আঙ্গিকগুলোকেই মুক্তনাটক নির্মাণের আঙ্গিকের সঙ্গে যুক্ত করা হতো। এ ছাড়া চড়ক, দেল, হাজরার মতো লোকবিশ্বাসকেন্দ্রিক কৃত্যাচার অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী যুক্ত হতো মুক্তনাটকের নির্মাণ আঙ্গিকের সঙ্গে। এর ফলে মুক্তনাটক অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে দর্শক সংযোগ ঘটাতে সক্ষম হতো। দর্শকদের কাছেও মুক্তনাটক হয়ে উঠত অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। কেননা মুক্তনাটক তাদের নিজেদের এবং চারপাশের সমস্যা সংকটকে তুলে ধরত তাদেরই অতি চেনা আঙ্গিকে, যা এর আগে দেখা প্রচলিত যাত্রা, কবিগান বা পুঁথি-পাঁচালীতে তারা দেখতে পায়নি। কি বিষয়বস্তু, কি আঙ্গিক, উভয় দিক থেকেই মুক্তনাটক ওই সময়ে এক শক্তিশালী ধারালো শৈল্পিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল এবং যা হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষের নিজস্ব শিল্প-সম্পদ। (চলবে)

আরবি/জেআই

Link copied!