ঢাকা শনিবার, ০৪ জানুয়ারি, ২০২৫

পরিবর্তনের অঙ্গীকারে নতুন বছর

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৫, ০৯:৩২ এএম

পরিবর্তনের অঙ্গীকারে নতুন বছর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অনেক নাটকীয়তা, অনেক উত্থান-পতন, পট পরিবর্তনের বছর হিসেবে ২০২৪ সাল বিদায় নিয়েছে। নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশা আর যুগান্তকারী পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে নতুন বছর ২০২৫। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। বঞ্চনা, নিপীড়ন, বৈষম্য, অনিয়ম, দুর্নীতি স্বেচ্ছাচারিতার বেড়াজালে আজও বন্দি দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা ১৯৭১-এ বিজয় অর্জনের পর যাত্রা শুরু করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু এই ২০২৫-এর শুরুতে এসে আমাদের সবার মনে প্রশ্ন, এখনো কি আমরা যথার্থভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? বিদায়ি ২০২৪ সালে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বড় খলনায়ক  ছিল নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দাম কমাতে পারেনি, তেমনি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারও তাদের চার মাসের চেষ্টায় তেমন একটা সফল হয়নি। ফলে বছরজুড়ে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ বাজারে গিয়ে দামের চাপে পিষ্ট হয়েছেন। মধ্যবিত্তের জীবনও কঠিন ও রূঢ় হয়ে গেছে। তাদের পাত থেকে খাবারের কিছু পদ কমেছে।

নিত্যপণ্যের দাম পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুপারশপগুলো মধ্যবিত্ত গ্রাহক ধরে রাখতে ব্যবসায়িক কৌশল পাল্টেছে। মিনিপ্যাক শ্যাম্পুর মতো গরুর মাংস, মাছ, মুরগি, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের কম্বো প্যাকেজ নিয়ে এসেছে, যা দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ ক্রেতাদের অসহায় আত্মসমর্পণের বার্তা দেয়। সরকার পরিবর্তন, তীব্র তাপপ্রবাহ, একাধিক বন্যা, পণ্য সরবরাহে ঘাটতি, আমদানি ও জ¦ালানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে বছরজুড়ে দেশে নিত্যপণ্যের বাজার অনেকটাই অস্থিতিশীল ছিল। বিশেষ করে ফার্মের মুরগি ও ডিম, আলু, পেঁয়াজ, চাল, সয়াবিন তেল এবং বিভিন্ন সবজির বাড়তি দামে ভোগান্তিতে ছিল নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষেরা।

মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে সাফল্য পাওয়া যায়নি। মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি ও বাজার তদারকি-এই তিনটির সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সংস্কার বিষয়ে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য প্রয়োজন। এই তিন লক্ষ্যের কোনোটিকে ছাড়া কোনোটি সফল হতে পারবে না। ঐক্যবিহীন সংস্কার কিংবা সংস্কারবিহীন নির্বাচন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে  হবে। জানুয়ারি মাসে সংস্কারের জন্য গঠিত ১৫টি কমিশনের প্রতিবেদন জমা হবে বলে আশা করা যায়। প্রত্যেক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হলো, প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। নির্বাচন সংস্কার কমিশন কী সুপারিশ করবে, তা আমাদের  জানা নেই। সব কমিশন বহু সুপারিশ তুলে ধরবে, আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে, যার যা-ই মতামত হোক না কেন আমরা দ্রুত একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কারের কাজগুলো করে ফেলতে হবে। নির্বাচনের পথে যেন এগিয়ে যেতে পারি, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণ ছাড়া জুলাইয়ের শহীদদের আত্মদান অর্থবহ হতে পারে না।

ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশকে আদর্শভিত্তিক সব ধরনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আবার প্রিয় বাংলাদেশকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের পথে ফেরাবার লক্ষ্যে কাজ চলছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। আমাদের ছাত্র-জনতা অটুট সাহসে শিশু হত্যাকারী ও পৈশাচিক ঘাতকদের মোকাবিলা করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে এমন নিষ্ঠুরতাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে সাহসী করে তুলেছে, বাকহীন বাংলাদেশ জোরালো কণ্ঠে আবার কথা বলার শক্তি ফিরে পেয়েছে। এই দৃঢ় কণ্ঠ আবার ঐক্য গঠনে সোচ্চার হয়েছে। ঐক্যই মূল শক্তি, জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিক মাত্রায় বলীয়ান করেছে। গত পাঁচ মাসে এই ঐক্য আরও শক্তিশালী হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার ক্রমাগত প্রয়াস চালাতে থাকায় আমাদের ঐক্য আরও মজবুত হচ্ছে। ঐক্যের জোরেই এখন আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি। এখনই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ।

এমন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেটা সব নাগরিকের জন্য সম্পদের ও সুযোগের বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করবে। এমন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ থাকবে যেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এই পরিচিতি অবান্তর হয়ে পড়বে। সবার একটিই পরিচয়- আমি বাংলাদেশের নাগরিক এবং রাষ্ট্র আমাকে আমার সব অধিকার প্রদান করতে বাধ্য। রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্য নাগরিকের কাছে আমার অন্য কোনো পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। যেখানে ব্যক্তিবন্দনার কোনো সুযোগ থাকবে না। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভু-ভৃত্যের কোনো সম্পর্কের সুযোগ থাকবে না। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এই সুযোগ যদি আমরা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হই, কিংবা অপারগ হই; তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের কোনো প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া হতে দিতে পারি না।

আমরা একতাবদ্ধভাবে এই সুযোগের প্রতিটি মুহূর্ত সর্বোত্তম কাজে লাগাব। আজ আমরা রাজনীতিবিদদের লুটপাট-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছি। হাসিনার ফ্যাসিবাদের কথা বলছি। হাসিনার ফ্যাসিবাদী হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এ দেশের আমলাতন্ত্র, এই প্রশাসন। এই প্রশাসন হাসিনার আকাম-কুকামের সহযোগী ছিল। হাসিনার বিচারের পাশাপাশি প্রশাসনের মধ্যেও যারা সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের মধ্যে ফ্যাসিবাদের দোসর ছিলেন, ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছিলেন, তাদের ন্যূনতম বিচারের মুখোমুখি অবশ্যই করতে হবে।

গত ৫০ বছরে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, মাফিয়ারা রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। পরিছন্ন তরুণ নেতৃত্ব বের করে আনতে হবে। এই যে রাষ্ট্র সংস্কার, এগুলো জনগণ মানবে না, যদি আমরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি। বেকারত্ব মোচনে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না যায়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক করা না যায়। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এ পরিস্থিতি ঠিক রাখতে পারছে না। তারপরও আমরা আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে চাই।

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার ‘বিশ্বের ১ নম্বর দেশ’ হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। কিন্তু সেসবের প্রায় সবই দুর্নীতি বা দুর্যোগের জন্য। এবার ব্রিটিশ সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট-এর বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে প্রোগ্রেস বা অগ্রগতির জন্য। আসুন, আমরা একবার বুকভরে শ্বাস নিই এবং গর্বের সঙ্গে বলি, বাংলাদেশ। প্রতি বছরের মতো গত বছরও বর্ষসেরা দেশ নির্বাচন করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট। তারাই ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নির্বাচিত করেছে। এ বছরেরই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ও নতুন দিকে দেশের যাত্রা শুরু করার বিষয়টিই বাংলাদেশকে তালিকার শীর্ষে নিয়ে এসেছে।

এই সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস এবং এটি ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন লাভ করেছে। এই অস্থায়ী সরকার শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে এবং দেশটির অর্থনীতিকেও স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। একজন স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা এবং আরও উদার সরকার গঠনের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য, আমাদের এবারের সেরা দেশ বাংলাদেশ। এবার, ২০২৪ সালের সেরা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে হবে। কবে নির্বাচন হবে তাও নির্ধারণ করতে হবে।

আদালতগুলোর নিরপেক্ষভাবে কাজ করা ও বিরোধী দলগুলোর সংগঠিত হওয়ার সময় পাওয়ার বিষয় প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনোটি সহজ হবে না। ফ্যাসিবাদকে হটানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন এই স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে এ দেশের মানুষ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য। যে কোনো ধরনের চরমপন্থা স্বাধীনতার অর্জনকে ভুলপথে নিতে পারে। এ ছাড়া টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রমে গতিশীলতা আবশ্যক। যাতে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখা যায়। একই সঙ্গে গত দেড় দশকে যারা নিপীড়নমূলক শাসন চাপিয়ে দিয়েছিল, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এ দেশে আর কোনো ফ্যাসিস্ট শাসক ফিরে আসতে না পারে।
   
 

আরবি/জেআই

Link copied!