মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর থেকেই বিশ্বব্যাপী চলছে নানা সমীকরণ। কেমন হবে ট্রাম্পের আমেরিকা? যদিও একবার ক্ষমতায় ছিলেন ট্রাম্প। তবে এবারের বিশ্ব ওলট-পালট হয়েছে। ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন যে আমেরিকা এবং বিশ্ব ছিল, এখন সেই জায়গায় নেই। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বও অনেকটা খর্ব হয়েছে। প্রতিযোগিতায় চীন এবং রাশিয়া সামনে এসেছে। কয়েকটি যুদ্ধে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে। সামরিক না হলেও সহায়তা করেও সেসব যুদ্ধ চলছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে প্রথমেই যুদ্ধ বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন এমনটা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু এই জাদু কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সেই পদ্ধতি ঠিক বিশ্লেষকরা বের করতে পারছেন না।
এত সহজেই বন্ধ হবে কি এসব যুদ্ধ? যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন উভয়পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে তাহলে ইতিহাসের পাতায় ট্রাম্পের নাম আরেকবার উঠবে এবং তখনই তিনি সত্যিকারের বৈশ্বিক নেতা হয়ে উঠতে পারবেন। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ রয়েছে সবচেয়ে আগে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব গভীর। ট্রাম্পের সময়েও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। সেক্ষেত্রে ইরানকে ট্রাম্প কীভাবে সামলাবেন সেটাও প্রশ্ন। আমেরিকা ‘ফার্স্ট পলিসি ইনস্টিটিউট’-এর অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি অবিলম্বে ওই যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তিনি তার সমর্থকদের জানান, তার অন্যান্য অগ্রাধিকার হবে মধ্যপ্রাচ্য এবং ‘দুর্নীতিগ্রস্ত, ভঙ্গুর, ব্যর্থ প্রশাসনকে পরিষ্কার করা’।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও যুদ্ধ বন্ধ করার বিষয়ে কথা বলেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের অবসান নিশ্চিতে ইউক্রেনকে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধ কূটনীতির মাধ্যমে আগামী বছর তিনি শেষ করতে চান। গত ১৬ নভেম্বর এক রেডিও সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জেলেনস্কি। প্রথম মেয়াদে জলবায়ু ইস্যুকে ট্রাম্পের পাশ কাটানো ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়; এবং পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তার প্রথম মেয়াদেই। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিষয়টি এখনো অমীমাংসিতই রয়েছে।
ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ পছন্দ করে সম্ভবত ট্রাম্পের এই আমেরিকা ফার্র্স্ট নীতিতে জোর দেওয়ার কারণেই। এছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষত চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে সেটাও নির্ভর করছে। প্রথম মেয়াদের পুরোটা সময় ধরেই চীনের সঙ্গে কেটেছে বাণিজ্য যুদ্ধে। সেসময় বাণিজ্য যুদ্ধ ছিল আলোচনায়। এ নিয়ে উত্তেজনাও কম হয়নি। আবার উভয় দেশের সম্পর্ক একেবারে খারাপ পরিস্থিতিতেও পৌঁছেছিল। ইতোমধ্যেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগ দিয়ে চমক এনেছেন তিনি। এখনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আর কিছুদিন বাকি আছে। ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন তিনি।
সেদিন থেকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হবে। বাইডেনের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্টের শেষবারের মতো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের কৌশল পুরোনো ধাঁচের না নতুন কিছু হবে সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন যেমন বিশ্বের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল সেভাবেই বিশ্বের পরিস্থিতিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসন্দেহে গত কয়েক দশক থেকে বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা, নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা, করোনা ও যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিও দুঃসময়ে, বেকারত্ব প্রভৃতি নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমেরিকার।
অভিবাসী নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন ট্রাম্প প্রশাসন। ১৭৯৮ সালের ‘এলিয়েন শত্রু আইন’ অনুযায়ী অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। এই আইন অনুযায়ী, শত্রু দেশগুলো থেকে আসা লোকজনকে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর এখতিয়ার রাখে সরকার। এই আইনে পাওয়া ক্ষমতাবলে ‘অপারেশন অরোরা’ নামে একটি অভিযান পরিচালনা করবে ট্রাম্প প্রশাসন। এই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়া লাখো অভিবাসীকে দেশ থেকে বিদায় করার পরিকল্পনা করছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে এক কোটিরও বেশি অবৈধ অভিবাসী বসবাস করছে। এটি নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ট্রাম্প এ নিয়ে সম্ভবত অনড় অবস্থানে থাকবেন। কারণ তিনি এটি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি গাজা সংঘাত নিয়েও সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে যতগুলো আন্তর্জাতিক সংকটে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেসবের প্রত্যেকটির সমাধান করবেন তিনি এবং এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন ইউক্রেন। প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক দক্ষতায় এগিয়ে থাকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার ভূমিকা শক্তিশালী করার নীতিও আগামী নির্বাচনে ফ্যাক্ট হয়ে কাজ করবে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য প্রশ্নের মুখে। বিশ্ব খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন বিশ্ব বহুমুখী ব্যবস্থায় অগ্রসর হচ্ছে। কোনো দেশ একক কোনো দেশের কর্তৃত্বের বদলে একাধিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সেক্ষেত্রে একসময় দ্বন্দ্ব থাকলেও তারা এখন পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
একদিকে রয়েছে মৌলিক কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব আবার অন্যদিকে রয়েছে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঐকমত্য। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বিশ্ব। সেই বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ২০২৩ সালে হামাসের বিরুদ্ধে শুরু করা ইসরাইলি হামলা গাজা ছাড়িয়ে লেবানন, সিরিয়া পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই যুদ্ধে বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলকে সহায়তাও করেছে। যুদ্ধ বন্ধ করার কার্যত কোনো উদ্যোগ বাইডেন প্রশাসন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুতরাং ট্রাম্পের মুখ থেকে যুদ্ধ বন্ধ করার ঘোষণা শুনে সাধারণই বিশ্ব কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে। কিন্তু কার্যত সেটা কতটা দ্রুত এবং কার্যকর হবে বা কোনো কৌশলে হবে সেটাই প্রশ্ন। ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের রেষারেষি দীর্ঘদিনের।
এই দুই দেশের ভিতর একটি কার্যকর শান্তি চুক্তি করা জরুরি। হামাসের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা লেবানন পর্যন্ত গড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের জীবনাবসান ঘটাচ্ছে। ফলে ট্রাম্পের উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। সেক্ষেত্রে নেতানিয়াহুকে কীভাবে যুদ্ধ বন্ধে রাজি করাতে পারবেন সেটাও প্রশ্ন। নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের চীন নীতিতেও পরিবর্তন আসতে পারে। তবে আগের বারের মতো বাণিজ্য যুদ্ধও বন্ধ হওয়া দরকার। এবং সম্ভবত এবার সেটা সেই মাত্রায় পৌঁছাবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাণিজ্যে একে অপরকে প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের আর্থিক উন্নয়নে এসব থেকে বেরিয়ে একটি চমৎকার সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তবে এখানে প্রভাব ফেলতে পারে চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক। চীন তাইওয়ানকে যেভাবে দেখে আসছে যুক্তরাষ্ট্র তো সেখানে নেই। বরং সম্পর্ক বেশ ভালো। তাইওয়ান সম্পর্কেও ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমেরিকান ও তাইওয়ানি কূটনীতিকদের মধ্যে সম্পর্ক বাড়িয়েছিলেন, যা চীনের ক্ষোভের কারণ ছিল।
তাইওয়ান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে হস্তক্ষেপ করবে কি না-এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গত বছর ট্রাম্প এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। আরো বেশি কিছু বিষয়ই রয়েছে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পর যা পরিবর্তন হবে বা হতে পারে বলেই অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞগণ। বিশেষত ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান এবং মিত্রদের সঙ্গে কৌশল নির্ধারণেও ভাবতে হবে।
এর আগে দেখা গেছে, ট্রাম্প বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং মিত্রদের ওপর তার কিছুটা দিয়েছেন। এমনকি ন্যাটো নিয়েও ট্রাম্পের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ট্রাম্পের বিজয়ের পর বিশ্বের মনোযোগ যতটা না যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তার চেয়ে বেশি দৃষ্টি রয়েছে যুদ্ধ বন্ধ বিষয়ে। কারণ গত কয়েক বছর যুদ্ধ এই পৃথিবীটাকে প্রায় নরক বানিয়ে ফেলেছে। হাজার হাজার শিশু যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তারা মানবিক সব উপাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের চোখে অন্ধকার। এসব শিশুর ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্ব বিশ্বের। অতএব যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম কাজই হোক সব যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
আপনার মতামত লিখুন :