অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে পরবর্তী সরকার গঠন-প্রত্যাশী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)এর মধ্যে যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে তা এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। দীর্ঘ পনেরো বছর আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতনে বিপর্যস্ত দল বিএনপি ৫ আগস্টের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একক বৃহত্তম শক্তি হিসেবে বিবেচিত। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে তাদের সামনে দাঁড়ানোর মতো রাজনৈতিক শক্তি আপাতত নেই। ফলে লীগ সরকারের দেশ ত্যাগের পর থেকেই বিএনপি দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছে। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের একদিন পরেই, যখন দেশে কোনো সরকার ছিল না, ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে সমাবেশ করে দলটি দ্রুত সংসদ নির্বাচন দাবি করে।
পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার পরিকল্পনাকে সমর্থন জানালেও ‘অতিদ্রুত নির্বাচনের’ দাবি থেকে দলটি সরে আসেনি। তাদের সে ক্রমাগত দাবি এখন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কর অবনতি ঘটানোর অনুঘটকের কাজ করছে বলে অনেকে মনে করেন। গত ১৫ ডিসেম্বর ‘রূপালী বাংলাদেশ’-এর ‘সরকার-বিএনপি স্নায়ুযুদ্ধ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও বিএনপি নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য-মন্তব্য উল্লেখ করে দলটির সঙ্গে সরকারের অবনতিশীল সম্পর্কের কথাই তুলে ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের ‘রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে উসখুস করছে’ উক্তি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও দুপক্ষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলেনি। যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওই মন্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন দিতে দেরি করলে পতিত আওয়ামী লীগ ফিরে আসবে। আমরা আপনাদের সহযোগিতা করছি, আপনারাও সহযোগিতা করুন।’ এই সহযোগিতা বলতে মির্জা আলমগীর যে দ্রুত নির্বাচনকেই বুঝিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। তবে অতিসম্প্রতি তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের দুটি মন্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গত ১১ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে তাদের অধীনে সংস্কার হোক।
তাই তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করতে চাচ্ছে’। আর গত ১৩ ডিসেম্বর রাজধানীর গুলশানে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কিছুটা উষ্মার সঙ্গেই বলেছেন, ‘যদি রাজনীতিবিদেরাই সংস্কার করতে পারবেন, তাহলে ৫৩ বছর তারা কী করেছেন? রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণেই আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। সংস্কারকাজ শেষ হলে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।’ দুই উপদেষ্টার রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য সংগত কারণেই তাদেরকে ক্ষুব্ধ করেছে। যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে বিএনপি মহাসচিব ও অন্যান্য নেতার বক্তব্য-মন্তব্যে। যার ফলে রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয় কিনা সে আশঙ্কা করছেন রাজনীতি-সচেতন মহল।
এটা ঠিক, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো মৌখিকভাবে দ্রুত নির্বাচন দাবি করা ছাড়া দৃশ্যত সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক অচরণ করেনি। বরং যতবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলসমূহের বৈঠক-সংলাপ হয়েছে, ততবারই তারা সংস্কার প্রশ্নে সরকারকে সহযোগিতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তবে বিএনপি ও তাদের অনুগামী কয়েকটি সাইনবোর্ড-সর্বস্ব দলের কযেকজন নেতার নির্বাচন নিয়ে অতিমাত্রায় বাক্যগোলা বর্ষণ সরকারের ভেতরেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকবে। যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও বন এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের উক্তিতে।
বলা নিষ্প্রয়োজন, দীর্ঘ দেড় দশকের একটি রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ থেকে ৫ আগস্ট দেশ মুক্তিলাভ করেছে। ২০০৯ থেকে এ বছরের ৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র ছিল না। বলা যায়, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বাকশাল কায়েম ছিল। ওই সময়ের মধ্যে দেশের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ বাহিনীসহ নানা ক্ষেত্রে যে কায়েমি স্বার্থের শিকড় প্রোথিত হয়েছে, তাকে উপড়ে না ফেললে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বৃক্ষটি সাবলীল গতিতে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাবে না। শুধু ষোলো বছরই নয়, বলা যায় স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থায় যে অগণতন্ত্রিকতার বিস্তার ঘটেছে, তার অবসান না হলে আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যাবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা যে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ কথা বলছেন, তা প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে পাল্টে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিষয়টি উপলব্ধি করেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছেন, কাজও শুরু করেছেন।
দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে অতিউন্মুখ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটি কথা মনে রাখেতে হবে- ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রচলিত ধারার কোনো রাজনীতিবিদ নন। দেশের এক মহাসংকটকালে গণ-অভ্যুত্থানের উদ্গাতা ছাত্রসমাজ সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিক্রমে তাকে রাষ্ট্রের নেতৃত্বে বসিয়েছে এবং দেশবাসী বিনা বাক্যব্যয়ে তা সমর্থন করেছে। সে সঙ্গে তাদের আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখে ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার অভিপ্রায় ড. ইউনূসের নেই। তিনি আন্তরিকভাবেই রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অর্থবহ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে যেতে চান। যাতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে কোনো দল কর্তৃত্ববাদী বা ফ্যাসিবাদীর রূপ পরিগ্রহ করতে না পারে। সেজন্য যে সময়ের প্রয়োজন, তা দিতে কার্পণ্য করা রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে না।
এদিকে ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের সকালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কারের যে আকাক্সক্ষা সেটা বাস্তবায়নে প্রতিটি কমিশনই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের কথা আমি একটু আলাদাভাবে বলতে চাই। কেননা, এ দুটি কমিশনের সুপারিশের ওপর প্রধানত নির্ভর করছে আমাদের আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি ও তারিখ।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি।
তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।’ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে আগামী নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তবে ‘প্রত্যাশিত সংস্কার’ বলতে তিনি কী ইঙ্গিত করেছেন তা স্পষ্ট নয়। বিশেষত যেখানে জাতির প্রত্যাশা একটি নতুন বাংলাদেশের। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তম্ভের প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই সে বাংলাদেশকে নতুন রূপে উপস্থাপন সম্ভব।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও তাকে রোডম্যাপ হিসেবে মানতে নারাজ বিএনপি। তারা বলছেন, ড. ইউনূস কোনো রোডম্যাপ দেননি, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সম্ভাব্য ধারণা দিয়েছেন। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘প্রয়োজনীয় কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করা হবে, সে জন্য কতটা সময় প্রয়োজন, তা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে স্পষ্ট নয়। আমরা আশা করি তিনি সংস্কার ও নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট করে একটি রোডম্যাপ দেবেন।’ বিএনপির এই প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে, তারা প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় খুশি হতে পারেনি। মূলত তারা নির্বাচনের জন্য এতটাই ব্যাগ্র হয়ে উঠেছেন যে, আওয়ামী লীগের পনেরো বছরে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া সংবিধান, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় আনতে যেটুকু সময় দরকার তার অপেক্ষা করতে রাজি নন।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতিপূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য ‘পর্যাপ্ত সময়’ দেওয়ার কথা বললেও সম্প্রতি তিনিও সুনির্দিষ্ট করে জানতে চেয়েছেন উল্লিখিত কর্মসম্পাদনে কত সময় লাগবে। গত ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে চাইছে? রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের আর কত সময় প্রয়োজন? সেটা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।’ একই সভায় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘এখন তারাই আমাদেরকে সংস্কারের কথা শোনান, যারা পদগুণে বুদ্ধিমান, পতাকাগুণে শক্তিমান।’(রূপালী বাংলাদেশ, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
বিএনপি নেতাদের এহেন বক্তব্য-মন্তব্য থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এবং সেজন্য নির্বাচনে বিলম্ব হওয়া তারা মেনে নিতে পারছেন না। আর সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে কার্যত নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ ঘোষিত হলেও তা তাদেরকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। সচেতন ব্যক্তিদের প্রশ্ন- বিএনপি কি আদতেই রাষ্ট্র সংস্কার (তাদের ভাষায় মেরামত) চায়, নাকি আওয়ামী লীগবিহীন ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে নির্বাচনের ট্রফি নিয়ে ঘরে, মানে ক্ষমতায় যেতে চায়? তবে সাধারণ মানুষের ভাষ্য হলো, আওয়ামী লীগের পতনে রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার যে সিংহদ্বার অবারিত হয়েছে, অহেতুক বাগ্যুদ্ধে সে পথে যেন অনাকাক্সিক্ষত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের পক্ষশক্তির বিভাজনে এর শত্রুরা অনুপ্রবেশের মওকা পেয়ে থাকে। অতএব সাধু সাবধান!
আপনার মতামত লিখুন :