বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দিকে। এই নতুন বিপ্লবের মূলে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস এবং বিগ ডেটা। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে বাংলাদেশকেও প্রস্তুত হতে হবে। তবে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ এবং শিক্ষার্থীরা কতটা প্রস্তুত এই বিপ্লবকে মোকাবিলা করতে? বাংলাদেশ সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ, যার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শিল্প ও প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে যেখানে উদ্ভাবনী এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
দেশে ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো উন্নয়নেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে। শহরাঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সহজলভ্য হচ্ছে এবং গ্রামাঞ্চলেও ইন্টারনেট সংযোগের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। তবে, এখনো অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। বিভিন্ন শিল্প ও প্রতিষ্ঠানে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীর চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদা পূরণে বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়নের কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হচ্ছে।
যদিও অনেক অগ্রগতি হয়েছে, তবু কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। দেশে এখনো একটি বড় অংশের মানুষ প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন নন এবং তাদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও আগ্রহের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া, প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন স্টেম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, ও গণিত শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রবোটিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা সায়েন্সের ওপর কোর্স চালু করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সেমিনার আয়োজন করা হচ্ছে যাতে শিক্ষার্থীরা এই নতুন প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ এই বিপ্লবের সুফল পেতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ অবশ্যই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে তথা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিক্যুলামের প্রবর্তন এবং এই কারিক্যুলামকে সামনে রেখে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই কারিক্যুলাম বাস্তবায়নের আগেই মুখ থুবড়ে পড়ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, কারিক্যুলাম রিফর্ম বা পরিবর্তনের আগে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে কোনো ধরনের গবেষণালব্ধ ডেটা ব্যবহারের তাগিদ কারিক্যুলাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অনুধাবন করেননি।
নতুন কারিক্যুলাম বাস্তবায়নের আগে যথাযথ গবেষণা, পাইলট প্রোগ্রাম এবং সংশ্লিষ্ট সবপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি ছিল। ফলে প্রথম থেকেই শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা নতুন কারিক্যুলামকে অকার্যকর এবং দেশের চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জন্য অসন্তোষ এতই ব্যাপক ছিল যে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। এটা অনেকটাই সুনিশ্চিত যে কারিক্যুলাম সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনগুলো বাস্তব অর্থে ব্যর্থ হতে চলেছে, এ কাজে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে, তা রাষ্ট্রের এক ধরনের অপচয় হিসেবে পরিগণিত হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হচ্ছে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন, যেখানে প্রযুক্তি, ডেটা ও স্বয়ংক্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের শিল্পবিপ্লব ঘটছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার ও শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিকায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস এবং বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তি এখন শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারায় চলে আসছে। এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতখানি প্রস্তুত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার জন্য?
উচ্চশিক্ষা স্তরের ক্ষেত্রে ইউজিসি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আউটকাম বেজড এডুকেশনের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। আউটকাম বেজড এডুকেশন মূলত একটি অত্যন্ত কার্যকর শিক্ষণ পদ্ধতি, যা শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন গভীর বিচার বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ। যদি শুধু নির্দেশনা দিয়ে এই পরিবর্তন আনা হয়, তবে এটি কার্যকর হবে না।
শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) গঠিত হয়েছে। তবে এই সেলগুলো যদি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মাবলি পূরণ করার জন্য গঠন করা হয় এবং এর কার্যকারিতা সঠিকভাবে পর্যালোচনা না করা হয়, তবে তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পরিকল্পনা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য কতটা কার্যকর, আমরা কি বিচার বিশ্লেষণ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, নাকি এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো ট্রায়াল অ্যান্ড এরর বেসিসে পরিচালিত হবে?
ট্রায়াল অ্যান্ড এরর ভিত্তিতে পরিচালিত পরিকল্পনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে অপ্রত্যাশিত ফল দিতে পারে। সুতরাং, পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে গভীর চিন্তা, গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। শুধু পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেই হবে না, এর সঠিক বাস্তবায়ন ও পর্যালোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন কোর্স অফারিংয়ের ক্ষেত্রে এবং চলমান কারিক্যুলাম রিভিশনের ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্টেকহোল্ডারকে কতখানি কাজে লাগাচ্ছি, সে বিষয়টিও প্রশ্নসাপেক্ষ। আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারার কারণে চাহিদা ও জোগানের যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে, এই শূন্যতা আমরা কীভাবে দূর করব সে বিষয়েও আমাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
উন্নত বিশ্বে মূলধারা থেকে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের পরবর্তী সময়ে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্সের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে এ ধরনের আরও উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে। এ ধরনের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে যেকোনো মানুষ যেকোনো বয়স বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারায় সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। অথচ আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে শুধু একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন বয়সী লোকদের শিক্ষার মূলধারায়সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রহিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে ইভিনিং প্রোগ্রামের আওতায় বিভিন্ন কোর্স অফার করা হচ্ছে।
এসব কোর্সের গুণগত মান এবং বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। তাই দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য আমাদের দরকার ইউনিভার্সিটি ও ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে সুসমন্বয়। গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গ্র্যাজুয়েটরা কোনো ধরনের দক্ষতাগুলো শিল্পক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পেরেছে আর নতুন করে কোনো ধরনের যোগ্যতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, তা যাচাই করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে যুগোপযোগী করে তোলার জন্য অ্যালামনাইদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে চাকরিদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েট জোগান দিতে পারছে না তার সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গ্রেডের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার পদে নিয়োগ পরীক্ষা। প্রায় ৫ হাজার পরীক্ষার্থী ওই পদের জন্য আবেদন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো প্রার্থীকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যোগ্য মনে না হওয়ায় কাউকে নিয়োগ দেয়নি।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষক এখনো প্রযুক্তির সঠিক ধারণা ও ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জানেন না, যা শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়ার একটি বড় কারণ। চাকরির বাজারে চাহিদা ও জোগানের এই সমন্বয়হীনতা এবং পরিকল্পনাহীনতাকে পুঁজি করে আমরা কীভাবে চতুর্থ বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তির কথা বিবেচনা করছি, তা বোধগম্য নয়।
শুধু স্বপ্নবিলাসী সম্ভাবনার দিবাস্বপ্ন না দেখে আমাদের উচিত হবে কার্যকর ও সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চাকরিদাতাদের সুসমন্বয়ের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ গ্র্যাজুয়েট সরবরাহে মনোযোগী হওয়া।
সর্বোপরি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারিক্যুলামকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে গার্মেন্টস সেক্টরসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ও ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। এ জন্য চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী স্কিল নির্ধারণ করে শিক্ষার নিম্নতর স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত কারিক্যুলাম এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকর পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।
এ ধরনের গুণগত পরিবর্তনকে বিচ্ছিন্ন উপাদান হিসেবে না দেখে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, অন্যথায় কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত নাও হতে পারে। এ ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমে প্রযুক্তি সংযুক্তকরণ, শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করতে পারে। সরকারের উচিত এই বিষয়ে আরও বিনিয়োগ করা এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথকে সুগম করতে পারে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন একটি বাস্তবতা। এটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা কেমন অনুভব করি, কীভাবে কাজ করি, কীভাবে থাকি, ভ্রমণ করি সবকিছুই বদলে যাবে। প্রথম শিল্পবিপ্লব হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন নিয়ে, দ্বিতীয় বিপ্লবটি বিদ্যুতের, তৃতীয়টি ইন্টারনেট ও কম্পিউটারবিষয়ক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটছে ইন্টারনেটের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তা যোগের মাধ্যমে।
একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কোম্পানির একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সকালে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা অ্যাপল সিরি দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিংবা যানজট চেক করতে পারেন, স্বচালিত গাড়ি ব্যবহার করে অফিসে যেতে পারেন, সেখানে রোবট তাকে স্বাগত জানাতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন, মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ব্যবসায়িক মডেল ডিজাইন করতে পারেন, ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে বাসাবাড়ির ইলেকট্রনিকস ও অ্যাপ্লায়েন্স নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং আরও অনেক কিছু করতে পারেন।
বাংলাদেশে শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে ফাইভ-জি ইন্টারনেট। এটি ব্যবসার মডেল, জীবনযাত্রার মান, শিক্ষাপদ্ধতি, ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়া, যা গত এক দশক ধরে দেখে আসছি, তার ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক জায়গায়, যেমন- স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোরআইআর) সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের জনশক্তি প্রস্তুত করছে। এ কারণেই এই দেশগুলো তাদের শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসকে একীভূত করেছে, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত তাদের মানবসম্পদের জ্ঞানীয় মনকে ফোরআইআরের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে।
এখন বিশ্লেষণ করা যাক, বাংলাদেশ কীভাবে বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি উদীয়মান রোল মডেল হতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি শক্ত। গত ১৫ বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশে, প্রায় প্রতিটি খাতের পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আইসিটি খাত প্রভাব ফেলেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এখন ফাইবার অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হচ্ছে; স্কুলগুলো এখন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়ে সজ্জিত; হাজার হাজার ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হয়েছে; ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হয়েছে ইত্যাদি। এভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের দেশে ফোরআইআর চালু করার জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।
ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার। ব্লেন্ডেড লার্নিং হতে পারে সারা দেশের উচ্চ প্রযুক্তি, নিম্ন প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিহীন জনগণকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি ভালো সমাধান। ইউজিসি সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি ২০২১ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে এবং এখন সরকার এটিকে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করছে।
ভবিষ্যৎ কাজগুলো হবে এমন, যা মেশিন করতে পারে না, একই সঙ্গে সৃজনশীল প্রচেষ্টা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো ক্ষেত্রগুলো যেখানে মানুষ মেশিনকে হারাতে পারে, সেই ক্ষেত্রগুলো চাকরি সৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এখন আমাদের নীতি-নির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা, যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী ও দক্ষ দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারি। তাই আমাদের উচিত নতুন নতুন উদ্ভাবন করা।
আপনার মতামত লিখুন :