দেশের অর্থনীতি যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার অন্যতম ধরা হয় পোশাকশিল্পকে। রপ্তানি আয়ের বেশির ভাগই আসে এ খাত থেকে। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই শিল্প ঘিরে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়াকে সামনে রেখে আন্দোলন করছে পোশাক-শ্রমিকরা। আর এই আন্দোলনের মুখে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ রাখতে হয়েছে কারখানা। আজ এখানে তো, কাল অন্যখানে গণ্ডগোল লাগছে। আর এর ফলে ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার-আশুলিয়া-গাজীপুর আগুন খেলার এক ময়দানে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া, এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বৈদিশিক মুদ্রা মজুদের প্রধান খাত হিসেবে বিবেচিত এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা আশঙ্কা।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সবাই প্রত্যাশা করেছিল তার ইমেজকে কাজে লাগিয়ে পোশাকশিল্পে বড় একটি জাম্পিং আসবে। কিন্তু প্রত্যাশিত সেই জাম্পিং আসা তো দূরের কথা সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিরতার কারণে উল্টো পোশাকশিল্প পড়েছে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। অবস্থা এমন যে, রপ্তানিমুখী কারখানার পাশাপাশির বিভিন্ন খাতের সাধারণ কারখানাও হামলা-লুটপাট থেকে রেহাই পাচ্ছে না। পত্রিকার পাতা খুললেই শ্রমিক বিক্ষোভ আর শিল্প ধ্বংসের খবর। পরিস্থিতি কারা উত্তপ্ত করছে তা মালিকপক্ষ জানে, বিনিয়োগকারীরাও জানে। সরকারেরও না বোঝার কথা নয়। কিন্তু অ্যাকশনটা সেই অর্থে হচ্ছে না। ফলে সমাধানও আসছে না।
সাধারণত শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, নিয়মিত বেতন পাওয়া, শ্রমপরিবেশ নিশ্চিত করার মতো দাবিগুলোকে সামনে রেখে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। এবারও তেমন কিছু দাবি সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হলেও দাবিগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কারখানা বন্ধ করে আন্দোলন করার মতো বড় কারণ সেখানে অনুপস্থিত। সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে কী কারণে পোশাক খাতে এভাবে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে? মূলত তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা হঠাৎ করে কিছু অপ্রচলিত ইস্যু সামনে নিয়ে আসায় পোশাক শিল্পাঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন যে, জাতি যখন নাজুক পরিস্থিতিতে, তখন কেন এই অস্থিরতা? বিশেষ করে, গত বছরের ডিসেম্বরে যখন পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো কার্যকর করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আলোচনার আগে যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখা যাবে- পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০০৬ সালে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ছিল। সরকার ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি ৮০ দশমিক ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা, ২০১৩ সালে ৭৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা, ২০১৮ সালে ৫০ দশমিক ৯৪ শতাংশ বাড়িয়ে আট হাজার টাকা আর ২০২৩ সালে ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। তাছাড়া সরকার শ্রম আইনের মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা বিধান এবং সেই মজুরি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণ করার মাধ্যমে ভূমিকা রাখলেও এই খাত থেকে অসন্তোষ দূর হয়নি।
২০২৩ সালে ২০১৮ সালের চাইতে ন্যূনতম মূল মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪,৫০০ টাকা এবং শতকরা হিসাবে যা ৫৬.২৫%। এই বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে সন্তোষজনক হলেও সমস্যা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের মাত্রাতিরিক্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। এই বেতনে শ্রমিকরা কীভাবে সংসার চালাবেন সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, আমাদের বেশিরভাগ পোশাক কারখানাগুলো গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জের মতো যে শহরগুলোতে অবস্থিত সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় দেশের অন্য অঞ্চলের চাইতে অনেক বেশি। ফলে এই বেতন দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এখানে শ্রমিকরা তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খায়। এই কারণে আন্দোলনের ডাক দিলেই শ্রমিকদের মাঠে নামানো সহজ হয়।
এর পাশাপাশি বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে সক্রিয় থাকা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও আন্দোলনে ইন্ধন দেয়। কারণ, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের খ্যাতি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ-ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও কম্বোডিয়ার পোশাকপণ্য পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া পোশাকশিল্পে দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষ থাকা চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থানটিই বাংলাদেশের। ফলে দেশি-বিদেশি অপশক্তি, যারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে চায় তারা বিভিন্ন উপলক্ষ সৃষ্টি করে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলে। তাদের বোঝানো হয়, বাংলাদেশের শ্রমিকরা শোষিত, তাদের ঠকানো হচ্ছে। নিজেদের অধিকার তাদের নিজেদেরই আদায় করতে হবে। কিন্তু শ্রমিকরা এটা বোঝে না যে- অধিকার আদায়ের নামে এ রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলে বা হামলা-ভাঙচুর চালানো হলে শিল্প বিপর্যস্ত হতে পারে, লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মপরিধি সংকুচিত হতে পারে।
শিল্প মালিকরাও মনে করছেন, একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই শিল্পকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। বিকেএমইএর সভাপতি সম্প্রতি বলেছেন, ‘রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে পোশাক কারখানায় হামলা-ভাঙচুর চালানো হচ্ছে।’ বাংলাদেশের শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির মাধ্যমে পোশাকশিল্প কারখানা বন্ধ রাখা গেলে নিশ্চিতভাবেই অনেক ক্রয়াদেশ এখান থেকে অন্য দেশে চলে যাবে। আর এসব ক্রয়াদেশ স্বভাবতই প্রতিযোগী দেশগুলোই পাবে।
এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন পোশাক শিল্পের মালিকরা। কারণ, শ্রমিক অসন্তোষের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিন উপলক্ষে প্রতি বছরই এ সময়েই ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার পেয়ে থাকে কারখানাগুলো। শার্ট, প্যান্ট, কোর্ট, জ্যাকেটের মতো ফ্যাশনেবল আইটেম থাকে এ সময়টার অর্ডারের তালিকায়। নভেম্বরের মধ্যে এসব তৈরি করে পৌঁছাতে হয় বায়ারদের কাছে। সেখানে এখন ছেদ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এর পাশাপাশি যথাসময়ে এই পণ্যগুলোর শিপমেন্ট নিয়েও বাড়ছে চিন্তা। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে উৎপাদন শেষ করতে না পারলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এয়ার শিপমেন্ট করতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তাছাড়া, চলমান অস্থিরতা দমন করতে না পারলে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখাও কঠিন হবে। এর প্রভাব পড়বে আগামী সিজনের কার্যাদেশেও। এমনিতেই দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন ও গত আড়াই মাস ধরে চলা শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে ১৫-২০ শতাংশ কম কার্যাদেশ পেয়েছে দেশি কারখানাগুলো। এখন এই অস্থিরতার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যাদেশ না পেলে শ্রমিকদের বেকার হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
পোশাক কারখানাগুলোর চলমান সংকট ও উত্তরণের পথ নিয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) এক মতবিনিময় সভায় শ্রমিক অসন্তোষের জন্য তিনটি কারণ দায়ী বলে উল্লেখ করেন সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা। কারণগুলো হলো- বহিরাগতদের আক্রমণ-ভাঙচুর, শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা এবং ঝুট ব্যবসার আধিপত্য। শ্রমিক নেতারাও বলছেন, ক্ষমতার পালাবদলে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, ঝুট ব্যবসা এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে শিল্পাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে। এই গোষ্ঠীটি ইস্যু সৃষ্টি করে যাদের মাধ্যমে নৈরাজ্যকর পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে, তারা কেউ শ্রমিক না, সবাই বহিরাগত। এই বহিরাগতদের মাধ্যমে কারখানায় হামলা চালিয়ে, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। আর তখন শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে মালিকরা বাধ্য হয়ে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের অগ্রযাত্রা প্রায় চার দশকের। তবে প্রথম দিকে যেনতেনভাবে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। তখন কাজের মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন ছিল। তাছাড়া, শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টেস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে রানা-প্লাজা ট্র্যাজেডির পর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন হলো পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপন। বিশে^ পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনার শীর্ষে থাকা অর্ধেকই বাংলাদেশের পোশাক কারখানা। বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে বর্তমানে লিড সনদ পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে ২১৮। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম সনদধারী ৮৪, গোল্ড ১২০, সিলভার ১০ ও ৪টি কারখানা সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। এর পাশাপাশি, বিশে^র ১০০ পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার মধ্যে ৫৬টি অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কারখানা বাংলাদেশের। এসব অর্জন জাতিকে বিশ^জুড়ে গর্বের স্থানে নিয়ে গেছে। ফলে ‘মেড ইন বাংলাদেশ লেখা’ পোশাক সারা বিশে^র নামি-দামি ফ্যাশন হাউসগুলোতে বহু আগে থেকে স্থান করে নিয়ে এখন পর্যন্ত অবস্থান ধরে রেখেছে গৌরবের সঙ্গে।
আন্দোলনের জন্য সঠিক সময়টি বেছে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। না হলে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হয়। এই ক্ষতি যারা আন্দোলন করে তাদের যেমন হয়, যাদের বিপক্ষে করা হয় তাদেরও হয়। তাই, পোশাক শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভাবা উচিত আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার এবং মালিকপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের সেই উপযুক্ত সময় কি আসলেই এখন? যদি না হয় তাহলে উদ্ভট সব দাবির আড়ালে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে কোনো বিশেষ শ্রেণি পোশাক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলছে কি না সেটা খুব দ্রুতই খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাত হুমকিতে পড়লে মালিক-শ্রমিক যেমন বিপদে পড়বে তেমনই সারা দেশের অর্থনীতিও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আপনার মতামত লিখুন :