ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

পলিথিন নিষিদ্ধ বাস্তবায়নে গণসম্পৃক্ততা প্রয়োজন

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৪, ০৩:২৯ পিএম

পলিথিন নিষিদ্ধ বাস্তবায়নে গণসম্পৃক্ততা প্রয়োজন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বাজারে সব জিনিসের এমন চড়া দাম। বাজার স্থিতিশীল করতে সরকারের কোনো উদ্যোগই চোখে পড়েনি। জাতি হতাশ। বাজারে যখন আগুন, নতুন সরকারের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন। ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে আরেকটি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। বাজারে পলিথিন নিষিদ্ধ। প্রথমে শপিংমলে তারপর অন্যসব জায়গায় এটি নিষিদ্ধ হবে। পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ ক্রেতাদেরই কিনতে হবে।

সম্ভবত, অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পলিথিনের আগে বাজার দর ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতা জাতি আশা করেছিল। কেননা বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল কোনো দেশে এটি বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। তা ছাড়া বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই হঠাৎ পলিথিন নিষিদ্ধ করা একটি ‘ফ্যাসিবাদী’ চিন্তা বলে আমি মনে করি। বলা হচ্ছে, পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কি দেশে এই মুহূর্তে পর্যাপ্ত, দামও কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে? নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এটি একটু আর্থিক চাপ বাড়বে। কারণ তাদেরই ব্যাগ কিনে বাজার করতে হবে। চাপিয়ে দেওয়া এই সিদ্ধান্ত নতুন করে সংসারের খরচ বাড়াবে।

বাজার সিন্ডিকেট, নিত্যপণ্য সহজলভ্য না করে এসব সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হবে না। আমি বলব এটি লোক দেখানো কাজ। বর্তমান সরকারকে এমন সস্তা জনপ্রিয় হওয়ার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমি নিজেও একজন পরিবেশবাদী সংবাদকর্মী। আমি নিজেও চাই এই পলিথিন নিষিদ্ধ হোক। তবে তা হতে হবে যৌক্তিক উপায়ে। জনমতকে উপেক্ষা করে নয়। সবাইকে নিয়ে আলোচনা করে। প্রস্তুতি ছাড়া পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত অতীতের মতোই ব্যর্থ হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অনেকেরই জন্ম ২০০৩ সাল বা তারপরে। তারা হয়তো জানেই না এর আগে বাংলাদেশে সরকারিভাবে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর বিধান অনুসারে ২০০২ সালের ১ মার্চ সরকার বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। যদিও তা কার্যকর হয়নি সর্বস্তরের মানুষের অসহযোগিতার কারণে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে কোনো ধরনের পলিথিন বা পলি-প্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে। (দ্য ডেইলি স্টার বাংলা, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪) তার এই ঘোষণা কি আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব? এমন ঘোষণা তো এর আগেও হয়েছে। জাতি দেখেছে সেই সিদ্ধান্ত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এবার নতুন সরকার কি এমন জাদুবিদ্যা কাজে লাগাবে তা আমার জানা নেই।
গতবারের অভিজ্ঞতাও ভিন্ন কথা। উৎপাদন নিষিদ্ধ হলেও প্রায় তিন হাজার কারখানায় দৈনিক এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। (প্রথম আলো, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪)

এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিনের অর্থনীতি বিশাল। এর ভাগিদারও অনেক। ভোক্তার সংখ্যাও কম নয়। এত বড় একটি সমস্যা এক ঘোষণায় বাজিমাত সমাধান করবেন- এটা ভাবাও ঠিক নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। কারণ আইন ভাঙায় বিশ্বসেরাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা অন্যতম। আমার মতে, এটা নিয়ে জাতীয় সংলাপ হতে পারত। সেখানে সব শ্রেণির-পেশার মানুষ থাকত। দেশের গণমাধ্যম তা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারত। তখন মানুষ পলিথিনের ভয়াবহতা জানতে পারত। গড়ে উঠত জনমত। তখন সম্মিলিতভাবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলে তা মেনে চলত গোটা জাতি। কিন্তু তা না করে সরকার উল্টো পথে হাঁটল কি-না ভাবা দরকার।

বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে পলিথিন নিষিদ্ধ হয় ২০০২ সালে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। ২০০২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পলিথিন নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও কেন কোনো রাজনৈতিক সরকার তা বন্ধ করতে পারেনি? এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে সমাধান। পলিথিন পচে না। শত শত বছর মাটির নিচে অক্ষত থাকে।

এটি নষ্ট হতে ২ থেকে ৪শ’ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। পলিথিন একই সঙ্গে কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, পলিথিন বা প্লাস্টিকের সমগোত্রীয় মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন লবণ, চিনি, মাছের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ভয়ের কথা হচ্ছে, মায়ের দুধেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। ভয়াবহ এই তথ্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার হওয়া দরকার। নয়তো একজন মুদি দোকানদার কেন পলিথিন বন্ধ রাখবে। একজন ক্রেতা কেন পলিথিনকে বর্জন করবেন?

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। পলিথিন ছাড়া অন্য প্লাস্টিক বর্জ্যও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে না বলেই ঢাকার বাতাস বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বলে খবরের শিরোনাম হয় বছরজুড়ে। বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বজুড়ে পলিথিনের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনাকে চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ এই পলিথিন। ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ ড্রেন পলিথিনে আবদ্ধ। তাই সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকায় জলজট তৈরি হয়।

পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগের কথা বলা হচ্ছে। এর আগে পাটের পলিথিন প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বিজ্ঞানী ড. মোবারক আহমদ খানকে। কিন্তু পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ জনপ্রিয়তা পায়নি। তার বড় কারণ জনমতকে উপেক্ষা করা। তা ছাড়া পাটের ব্যাগের চেয়ে অল্প খরচে পলিথিন তৈরি করা যায়। মূল বিষয় হলো, পলিথিনের অর্থনীতি অনেক বড়। এত বড় অর্থনীতির সুবিধাভোগী অনেক। এই সুবিধাভোগীরা হয়তো সাময়িক চুপ থাকবে কিন্তু তারা আবার ফিরবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার থেকে রাজনৈতিক সরকার সবারই পলিথিন নিষিদ্ধে এক থাকতে হবে। আগে জনমত গঠন, তারপর কঠোর হতে হবে সরকারকে। তাহলে ফল পাওয়ার আশা করা যায়। নইলে এবারও ব্যর্থ হবে সরকার।

বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধকে একটি আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা করা উচিত। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মতো সবাইকে জাগিয়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ হতে পারত পলিথিন নিষিদ্ধ। এ কাজে ব্যবহার করা যেত বিপ্লবী ছাত্রসমাজকে। তখন প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ সচেতন হতো। আইন মানার ব্যাপারে জনমত গড়ে উঠত। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা গেলেই কেবল পলিথিন বন্ধের সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখতে পারে। তারপরও নতুন সরকারের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
 

আরবি/জেআই

Link copied!