দুহাজার চব্বিশ সালের জুলাই-আগস্ট মাস। কতশত প্রাণের বিনিময়, আর হাজার হাজার জনের পঙ্গুত্ববরণের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতার বিপ্লব বলুন, আর অভ্যুত্থান বলুন, সেটা হলো। এ থেকে কী বোঝা গেল? বুঝলাম যারা ক্ষমতায় ছিলেন তাদের মধ্যে খাঁটি দেশপ্রেম ছিল না, ছিল না দেশের মানুষের প্রতি মমতা। তারা ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা টিকে থাকার জন্য যা ইচ্ছা তাই করেছেন। ছোট করে বললে এভাবেও কথাটা বলা যায়, ক্ষমতার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করেননি। তাদের সব কাজ ছিল দলপ্রেম, নিজপ্রেম (ব্যক্তি) আর স্বজনপ্রেম নিয়ে।
এ কারণে তারা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কেন তারা স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠলেন? কেন তারা খাঁটি দেশপ্রেমিক হয়ে উঠলেন না? কেবল কি এই বিগতদের কর্মকাণ্ডেই আমি দেশপ্রেমহীনতা বলব?-না আমি কেবল এই বিগতদের কথাই বলব না। আমার উপলব্ধি অতীতেও এমন ছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, যেসব রাজনৈতিক দল কিংবা দলসমূহ দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যেও দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি প্রেম থেকে বেশি মাত্রায় ছিল, দলপ্রেম, নিজপ্রেম আর আত্মীয়-স্বজনের প্রেম।
তাহলে করতে হবে কী? এই প্রশ্নের খুব ছোট জবাব হচ্ছে, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি লোক দেখানো প্রেম নয়, সত্যিকারের দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। দেশের সব মানুষ গড়ে উঠবে দেশপ্রেমিক হয়ে। দল থাকবে। সব দল মিলে সরকার গঠন হবে। দেশশাসন বলুন, আর পরিচালনা বলুন, সব দল মিলে সেটা করবে। সবার উপরে থাকবে দেশ। আর সবার অন্তরে দেশের অবস্থান থাকবে সবচেয়ে উপরে।
এমন একটা সমাজ গঠন করতে হবে, যে সমাজে নিজের স্বার্থ, দলের স্বার্থ, স্বজনের স্বার্থ প্রাধান্য পাবে না। প্রাধান্য পাবে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ। সব দলের চিন্তা থাকবে দেশের মানুষের কল্যাণ। আর এমন একটা ব্যবস্থা তৈরি করতে পরলেই দেশের উন্নয়নের সঙ্গে দেশের মানুষের উন্নয়ন হবে। সেই পুরোনো আমলের রাজনীতিবিদদের মতো নতুন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ব্রত হোক দেশের মানুষের কল্যাণ। সেই রাজনীতিবিদ চাই; যারা দেশ এবং মানুষের কল্যাণের জন্য সারা দেশ চষে বেড়াবেন। তাদের নিজের তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া থাকবে না। সব চাওয়া হবে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য।
এমন কি সম্ভব? জানি না, সম্ভব কিনা। তবে আশা করতে দোষ কী? আমি এমনই আশা নিয়ে নিজের চিন্তার কথা বলতে চাচ্ছি। এ কারণে বলতে চাচ্ছি যে, জুলাই অভ্যুত্থানে পাওয়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এ আওয়াজ উঠেছে সংস্কারের। সংস্কার সব ক্ষেত্রের মতো রাজনীতির মাঠ ও রাজনীতিবিদদের মননেও ঘটুক। খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা উঠে আসুক। তারা দেশের নেতৃত্ব দিক।
সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের এ সময়ে প্রচলিত সরকার ব্যবস্থার ব্যাকরণের বাইরে নতুন শাসনব্যবস্থা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে একটি ব্যবস্থার কথা বলছি। ব্যবস্থাটা এ রকম, সব সময় সব মত, সব পথের মানুষ নিয়ে দেশ পরিচালিত হবে। আমি বলতে চাইছি অনেক দল দেশে থাকবে। তবে দেশ পরিচালনা করবে সব দল মিলে। যে যেই দল করুন, সেটা তিনি করতে পারবেন। তার দলের নীতি আদর্শ মানুষের মধ্যে প্রচার করবেন। দেশের মানুষকে নীতি আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে নিজের দলে টানবেন। দেশের মানুষের মঙ্গল হবে এমন কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচন করবেন।
নির্বাচনে কোনো দল বেশি আসন পাবে, কোনো দল কম আসন পাবে। এমনই হবে। কিন্তু দেশ পরিচালনায় বেশি আসন প্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরা যেমন থাকবেন, কম আসনপ্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরাও থাকবেন। হোক সে দল জাতীয়তাবাদী, চেতনাবাদী, উদারপন্থি, অনুদারপন্থি, ডানপন্থি, বামপস্থি, পাহাড়ি, ইসলামিক, হিন্দুত্ববাদী, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টানের দল।
সংসদ সদস্য সবাই হবেন সরকারি দল, আবার সবাই বিরোধী দলও। অর্থাৎ দেশ পরিচালনায় কোনো ব্যত্যয় দেখলে কম আসনপ্রাপ্ত দলের সংসদ সদস্যরা যেমন বিরোধিতা করতে পারবেন, তেমনি বেশি সংসদ সদস্য নিয়ে যারা সংসদে এসেছে তাদের দলের সংসদ সদস্যরাও বিরোধিতা করতে পারবেন। সংসদে বেশি সংসদ সদস্য নিয়ে আসা দলের সংসদ সদস্যরা কোনো প্রস্তাব কিংবা বিলে বিরোধিতা করে ভোট দিলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হবে না। কম সংসদ সদস্য নিয়ে সংসদে আসা দলের সংসদ সদস্যরা প্রস্তাব কিংবা বিলে পক্ষে ভোট দিলে তিনি যে দলের হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারবেন সবাই। যার যার দল তাদের নিজের দলের মধ্যে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের মতো শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন।
মন্ত্রিপরিষদ গঠন হবে; সংসদে যে দল যত সংখ্যক আসন পাবে, তার ‘রেশিও’ অনুযায়ী। সংসদ সদস্যরাই মন্ত্রিপরিষদে অংশগ্রহণ করবেন। কোনো দলের দশজন, কোনো দলের সাতজন, কোনো দলের একজনও থাকতে পারেন। মন্ত্রিত্ব পাবার রেশিও অনুযায়ী কোনো দল সংসদে আসন না-ও পেতে পারেন। সেই দলকেও মন্ত্রিপরিষদের বাইরে রেখে কোনো দায়িত্ব দিয়ে দেশসেবার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। আর যাদের দল সংসদে কোনো আসনই পাবে না, তারা জনগণের কাছে ভালো ভালো কর্মসূচি নিয়ে থাকবে। আগামীতে যাতে জনগণ তাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠায়। তবে এটা কোয়ালিশন কিংবা জাতীয় সরকার, এমন ধরনের হবে না। সব দলের মিলিত দেশপ্রেমিক সরকার হবে। এটা একবার দুবারের জন্য নয়। সংবিধানে বিধান করে সব সময়ের জন্য।
তবে নির্বাচিত সব দলের সংসদ সদস্যদের মধ্যের যোগ্যদের নিয়েই মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হবে। দলগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত করবে তাদের দলের কে বা কারা মন্ত্রিপরিষদে যাবে। তবে মন্ত্রিত্বে আসা সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হতে হবে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণ করবেন। সেটা কণ্ঠ ভোট কিংবা গোপন ভোটের মাধ্যমে হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য একাধিক প্রার্থী হবেন। যিনি মন্ত্রীদের দেওয়া ভোটের মধ্যে বেশি ভোট পাবেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রিত্ব করার জন্য একাধিকজন নিয়ে প্যানেলও গঠন করে রাখা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তার বিবেচনায় কে কোন মন্ত্রণালয়ে ভালো করবেন সে অনুযায়ী মন্ত্রীদের দায়িত্ব দেবেন।
ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সিতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অবস্থান আগের মতোই রাখা যেতে পারে। তবে মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যরা আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। একজন সাধারণ মানুষের সংবিধান অনুযায়ী যে সুযোগ থাকবে, তারাও সেই সুযোগই পাবেন। মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের মোটা কোনো বেতন নয়, কেবলমাত্র সম্মানজনক একটি ভাতা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবেন। অর্থাৎ রাজনীতি ও দেশ পরিচালনাকে কোনো অবস্থাতেই লাভজনক পেশায় পরিণত করা যাবে না। যারা রাজনীতি করবেন তারা দেশসেবার জন্য করবেন।
রাজনীতিবিদদের অন্য পেশা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি দলীয় কোনো পদ নিয়ে তার সেই পেশার আয় উন্নতি করবেন, সেটা হতে পারবে না। আমি সংক্ষেপে নিজের স্বপ্ন, তথা মনের কথা বললাম। আমাদের সংবিধান যদি এ রকম সরকার গঠনের আলোকে সংস্কার করা হয়, তবে আমি মনে করি রাজনীতিবিদরা অসৎ হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। একইভাবে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের কাঠামোও হতে পারে।
দেশ পরিচালনার এই সিস্টেম চালু করার পর, দেশের মানুষ মূল্যায়ন করবে কোন দলের কোন নেতা কিংবা কোন মন্ত্রী ভালো করেছেন। আবার এটাও মূল্যায়ন করবে কোন দলের কোন মন্ত্রী খারাপ করেছেন। এমন মূল্যায়নে পরবর্তী ভোটে দেশের মানুষ কম আসনপ্রাপ্ত দলগুলোকে আর বেশি ভোট দিয়ে বেশি আসন দিতে পারে। আবার বেশি আসনপ্রাপ্তরা তাদের ভালো কাজের জন্য আরও বেশি আসন পেতে পারে। আর খারাপ করলে উল্টোটা হবে।
আমার জানার পরিধি সীমিত। বিশ্বের কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা আছে কি না, জানা নেই। তবে আমি মনে করি, যে কোনো দেশে এমন ব্যবস্থা চালু করতে পারলে রাজনীতিটা সত্যিকারের মানুষের রাজনীতিতে পরিণত হবে। আমি চাই আমার দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্বে নজির স্থাপন হোক। তবে এটা আমি জানি, প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক অংশগ্রহণমূলক ক্ষমতা ব্যবস্থার কথা। আমি সেই ব্যবস্থার কথা বলছি না। আমি বলছি সংসদীয় আসনপ্রাপ্তির অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক সরকার গঠন ব্যবস্থার কথা।
দেশের রাজনীতিবিদরা যদি দেশপ্রেমিক ও সৎ হন, তবে দেশের প্রশাসনের কোথাও অসততা দুর্নীতি স্থান পাবে না। শিল্পপতি ব্যবসায়ীরাও সততার সঙ্গে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবেন।
আপনার মতামত লিখুন :