অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখন ভারতে অবস্থান করছেন। এই তথ্য দিল্লি ঢাকাকে নিশ্চিত করেছে। যা মিডিয়ার বরাতে আমাদের জানা হয়েছে। তিনি ভারতে ঠিক কোন সত্তায় অবস্থান করছেন তা পরিষ্কার নয় বলে প্রচার করছে সরকার। গুঞ্জন রয়েছে তৃতীয় কোনো নিরাপদ দেশের সন্ধান পেলে ভারত ত্যাগের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এ ব্যাপারে ভারতের অস্বস্তির কথাও শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়। আদতে তার সত্যতা কতটুকু, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার ওপর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে তার পাসপোর্ট বাতিল করেছে। সেক্ষেত্রে তিনি ভ্রমণ করতে চাইলে ভারত থেকে ‘ট্রাভেল পাস’ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
ট্রাভেল পাস পেলে নিরাপদ যে কোনো দেশে ভ্রমণ করতে পারবেন বলে একাধিক সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে থাকছেন বলে প্রায় নিশ্চিত। কারণ তার নামে ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, তিনি ভারতেই থাকতে চান। ভারতে থেকে অডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যে আওয়ামী লীগের কয়েকটি সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন। তাতে দেশে না ফিরতে পারার আকুতি স্পষ্ট হয়েছে। সংবাদমাধ্যম পর্যালোচনা করে প্রকাশ করেছে তিনি শাস্তি ভোগ করার জন্য হলেও দেশে ফিরতে চান বলে প্রচার আছে।
বাংলাদেশের একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দলের এই দুঃসময়ে দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার বিকল্প নিয়েও ভাবা হচ্ছে বলে মনে হয় না। আর যারা এই মুহূর্তে দল নিয়ে ভাবছেন তারা কেউ শেখ হাসিনার শেষ দেখছেন না। সবাই চাইছেন শেখ হাসিনাই দলটির নেতৃত্বে থেকে সংগঠিত করুক। যেমনটি ঘটেছে তৎকালীন আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপির সঙ্গে। বেগম খালেদা জিয়াকে ‘জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ দুর্নীতি মামলায় সাজা হলে দণ্ড ভোগের জন্য প্রথমে কারাগার, পরে তারপর বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে সাজা স্থগিত করে নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিজ বাসভবনে অন্তরীণ রাখা হয়।
যদি সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তবে শেখ হাসিনাকেও দণ্ড ভোগের জন্য হয়তো এমন কোনো আদেশ আসতেও পারে। সেক্ষেত্রে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা ভারতের মাটিতে বসে যে ধরনের বিষোদগার করছে, সরকার ভালোভাবে নিচ্ছে না বলে যে অস্বস্তির কথা বলা হচ্ছে তা হয়তো বন্ধ হবে। আর শেখ হাসিনার বক্তব্য নিয়ে ভারত সরকারের অস্বস্তির কথাও বলা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে হাসিনার সমালোচনাকে সমর্থন করে না ভারত’। এ থেকেও একটা বিষয়ে বার্তা পাওয়া যায়, ভারতও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতেই আগ্রহী। অধিকন্তু, বাংলাদেশজুড়ে চরম ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ভারতও আঁচ করতে পেরেই নিজেদের অবস্থান থেকে বেরিয়ে নমনীয় হতে শুরু করেছে।
বিএনপি এবং জামায়াতের দাবার গুটি এদিক ওদিক হলেই আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়তে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। আদতে হয়তো সময় গড়াতে থাকলে তেমনটা না-ও হতে পারে। পরিস্থিতি ব্যাপক রদবদল হয়ে আবার আওয়ামী লীগ অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হবে বলেও বোদ্ধাদের ধারণা। এদিকে বিএনপিও বুঝতে পেরে গেছে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে তাদের ওপর আর খড়গ বাড়বে বৈ কমবে না।
অন্যদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ ইস্যু’ এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছে। যার দরুন পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ভ্রমণ দৃশ্যত অনিরাপদ। কারণ সেসব দেশে গেলে গ্রেপ্তার এড়াতে সংশ্লিষ্ট দেশের সদিচ্ছাই মূল নিয়ামক হবে। তাকে গ্রেপ্তার করতে সহায়তা করবেন নাকি নিজেরা গ্রেপ্তার করে তুলে দিবেন!
সেক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো ভ্রমণে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছে বলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে। আবার হাসিনা সরকারের আমলে করা ‘বন্দি বিনিময় চুক্তি’ অনুযায়ীও ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইতে পারে সরকার। যদিও সেই বন্দি বিনিময় চুক্তিতেও বেশ ফাঁক-ফোকর রয়েছে মর্মেও পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। শেষমেশ শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে গেলে ভারতের সদিচ্ছার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে।
অর্থাৎ যেকোনো একপক্ষ যদি না চায় সেই বিনিময় চুক্তি কার্যকর না-ও হতে পারে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। চলমান ভারতবিদ্বেষের কারণে দেশে লাগাতার অস্থিরতা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েনে পররাষ্ট্রনীতি যখন টালমাটাল অবস্থা তখন ভারতও সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে নমনীয় থাকার প্রেক্ষাপট এখন দৃশ্যমান। সেরকম অবস্থায় প্রতিবেশীসুলভ বন্ধুত্ব অটুট রাখা এবং আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গায় যাতে ঘাটতি না থাকে সেদিকটায়ও নজর রাখবে। যা সহজ সমীকরণও বটে। যা ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির বক্তব্যতেও স্পষ্ট।
তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী ভারত। এ থেকে কী বোঝা যায়? ভারত ধীরলয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইছে। দীর্ঘদিনের একপেশে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে নতুন করে সম্পর্ক উন্নয়ন করা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলজনক মনে করা হচ্ছে। আবার বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি বৈরী হয় তাহলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্যও হুমকিস্বরূপ। যা সাম্প্রতিক দুই বছর ধরে চলমান ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের জের থেকেও ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আবার প্রবল পরাক্রমশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত-চীন-পাকিস্তানের সম্পর্কের টানাপোড়েন থেকে নিশ্চয়ই ধারণা আরও স্পষ্ট হয়।
আবার উত্তর কোরিয়া-দক্ষিণ কোরিয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাব সারা বিশ্বকে অস্থির করে তোলে। অন্যদিকে একচ্ছত্র মোড়ল আমেরিকার আধিপত্যবাদের কথা বাদই দিলাম। অন্য অনেক দেশের চেয়ে সামরিক শক্তিতে যোজন যোজন এগিয়ে। তাদের ডলার সারাবিশ্বে ছড়ি ঘোরাচ্ছে। আর তাবৎ বিশ্ব চেয়ে চেয়ে দেখছে। কার্যকর কোনো মোকাবিলা করার মন্ত্রই খুঁজে পাচ্ছে না। যদিও ইউরো তেমন একটা প্রভাববিস্তারি নয়। তথাপিও ব্রিকস মুদ্রার কথা শোনা যাচ্ছে। তাতেও ডলারের দাপট ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। মনে হচ্ছে নিকট ভবিষ্যতে হবেও না।
তারপরও বাংলাদেশের ইতিহাসে যে কবার বিভিন্ন নামে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করেছে খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ। এরই ধারাবাহিকতায় স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সাংবিধানিক সংশোধনী ছাড়াই ১৯৯০ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। সেই সরকারের প্রধান হন তৎকালীন সময়ের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি শর্ত মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে আবার স্বপদে ফিরে যান। নির্বাচনে বিএনপি জোট জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তারপর সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তথাপিও নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি শুরু হলে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফা অনুষ্ঠিত হলে সব দল বয়কট করলে সেই সংসদ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। রাজনৈতিক মহলে নির্বাচনটি ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নামে পরিচিত।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনে জয় লাভ করে এবং ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৭৮টি আসন লাভ করে। ফ্রিডম পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি পায়। এ ছাড়া ১০টি আসনের ফল অসমাপ্ত থাকে ও আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপট উৎরে ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া সরকার ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংবিধানিকভাবে প্রণয়ন করে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এই যে নির্বাচন অনুষ্ঠান একতরফা হওয়ার নজির স্থাপন হয়।
তারপরের ইতিহাস সেই ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর মেয়াদ শেষে ২০০৫ সালে নির্বাচনে গড়িমসি তথা সাজানো কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে নির্বাচন করতে চেয়ে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়ানো হয়। আবার সংঘাত শুরু হলে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার আলোচনায় আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর একযোগে একাধিক উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে সংকট ঘনীভূত হয়। তখন সেনাপ্রধান সামনে আসতে থাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। সংস্কারের জন্য সময় চাওয়া হয়। ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ কার্যকরের চেষ্টা চলে। ব্যর্থ হয়। সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন ড. ফখরুদ্দীন আহমদ। মঈন উদ্দিন আহমেদও আলোচনায় উঠে আসতে শুরু করেন। যাকে সবাই ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিন সরকার বলেও চিনে থাকেন।
এতকিছুর পরও আবার আলোচনায় সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এবার আর মেয়াদ জানা যাচ্ছে না। কোনো কোনো উপদেষ্টা সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়ার নামে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছেন। আবার আইন উপদেষ্টা আগামী বছর নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলে ব্যাপক সমালোচনায় ব্যক্তিগত মত বলেও সে কথা চালিয়ে দিতে দেখা গেছে।
তাহলে কী হচ্ছে ভেতরে ভেতরে? সবকিছু খোলাসা হবে নির্বাচন হলে। তার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হচ্ছে! তবে সেই অপেক্ষার সময় কখন থেকে শুরু হবে? আমরা আমজনতা সেই গল্পের কৌতুকের মতো ‘দেখি ব্যাটা করে কী’!
আপনার মতামত লিখুন :