ঢাকা বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক চাপ বাড়ানো প্রয়োজন

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪, ০৫:৩১ পিএম

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আঞ্চলিক চাপ বাড়ানো প্রয়োজন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের একটি ঝুলন্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। একটি বিশাল জনসংখ্যা আশ্রয় দিয়ে অনির্দিষ্টকালব্যাপী অন্য কোনো দেশের আশ্রয়ে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাস্তবিকপক্ষে অসম্ভব। অন্তত বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট সেটাই বলছে। সু চিকে সরিয়ে সেনাশাসনে আসা মিয়ানমারের জান্তা সরকার এখন বিদ্রোহীদের ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছেন এবং সত্যিকার অর্থেই তার ক্ষমতা এখন আর আগের মতো শক্তিশালী নেই। বরং বিদ্রোহীরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তার প্রমাণ মেলে আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক প্রভাবে। মিয়ানমার মিলিটারির ওয়েস্টার্ন কমান্ড দখল করে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে আরাকান আর্মি। সেই সঙ্গে ডেপুটি রিজিওনাল কমান্ডার জেনারেল থাউং তুন এবং জেনারেল কেয়ো কেয়োকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি। এরপর থেকেই সেখানে বসবাস করা ৫ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। সেসঙ্গে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার শঙ্কা বাড়ছে।

এদিকে জাতিসংঘ বলছে, রাখাইনে মার্চ-এপ্রিলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। যা ২০ লাখ মানুষের খাদ্যসংকট তৈরি করবে। আগস্ট মাসের মধ্যেই মংডু ও তার আশপাশে তীব্র যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফায় অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। ওই সময় দুমাসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে দেশে। তখন আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত সাত বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে আরও দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। গত আগস্টের আগে-পরে নতুন করে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটে।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লক্ষাধিক। এরপর যদি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ঘটনা ঘটে অঞ্চলটিতে সেক্ষেত্রে প্রাণ বাঁচাতে প্রথম এবং এখন সম্ভবত একমাত্র পছন্দ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করবেই। আর এক শ্রেণির দালালের মাধ্যমে এর আগেও যেভাবে এসেছে তারা কিন্তু এদেশে আসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা খুব দ্রুত আশা করে। সেখানে যত দ্রুত সম্ভব নাগরিক বসবাসের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক। কিন্তু এর জন্য যে আঞ্চলিক চাপ থাকা দরকার বা ইনিশিয়েটিভ থাকা দরকার সেটি বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছে না। রোহিঙ্গা ঢলের এত বছর পরেও কেন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরুই করা গেল না সেটাই বড় প্রশ্ন। এভাবে আর কত বছর চলবে? বাংলাদেশ কেন বছরের পর বছর এই দায় নিতে যাবে? অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ফেরাতে একটি রোডম্যাপ খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে দরকার। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এক অনানুষ্ঠানিক পরামর্শ সভায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। মিয়ানমার ও তার প্রতিবেশী পাঁচ দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। মিয়ানমারে স্থায়ী শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্র দেখতে আগ্রহী বাংলাদেশ। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে দেশটির রাখাইন রাজ্যে ফিরতে, আত্মবিশ্বাসী করতে, বাংলাদেশ সেখানে অনুকূল পরিবেশ দেখতে চায়। এ জন্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের একটি পথনকশা (রোডম্যাপ) করার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা।

দিন যত যাচ্ছে ততই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে, রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ নানাবিধ বিপদে রয়েছে। এই ইস্যুগুলো আগেও আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে লাভ কিছু একটা হয়নি। এ কথা ঠিক যে রোহিঙ্গাদের একটি নিরাপদ আশ্রয় দরকার। কিন্তু সেজন্য তাদের বাসভূমিই হলো সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। অন্য কোনো দেশ সাময়িক সমস্যার সমাধান করতে পারে কিন্তু স্থায়ী সমাধান নিজ দেশেই। একটি বিপুল জনগোষ্ঠীর নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া, শিশুদের বড় হওয়া, নিরাপদ ভবিষ্যৎ গঠন ইত্যাদি এবং সর্বোপরি তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কার্যকর উদ্যোগ বা শুরু হওয়া এখনো সম্ভব হয়নি।

২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর সহিংসতা শুরু করার পর থেকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর মধ্যে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি এখন বেশি উত্তপ্ত। আবার বর্তমানের ইস্যুগুলোর ভেতর এই সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। অথচ এটা শুরু হওয়া উচিত। দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা বর্তমান পরিস্থিতিতে সমস্যা। বছরের পর বছর তারা এখানে থাকতে পারে না। কোনো দেশই এত দীর্ঘ সময় এত বিপুল জনগোষ্ঠী রাখেনি। অন্তত আমাদের মতো একটি ছোট দেশ এই সাহস দেখিয়েছে এটাই অনেক বড় ব্যাপার। রোহিঙ্গাদের ওপর এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। এটি ছিল আইনিভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি বড় অর্জন। এ মামলা হলে শুনানির পর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি একটি অন্তর্বর্তী আদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে আদেশ দেয় আইসিজে।  

এতকিছুর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করা। কিন্তু তাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে অগ্রগতি কমই হয়েছে। খণ্ড খণ্ড কিছু অগ্রগতি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য এখন এদেশের স্থানীয়রাই বিপদে আছে। স্থানীয় কৃষিজমি, বনভূমি ধ্বংস, শ্রমবাজারে রোহিঙ্গাদের কাজে লাগানোসহ নানাবিধ অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের জন্য বোঝা হয়ে উঠছে। মানবতার খাতিরে তাদের আশ্রয় দিলেও এখন তাদের ফিরতে হবে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, মাদকদ্রব্য, অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই আছে। কয়েকবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা কারণে এবং মিয়ানমারের টালবাহানায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অথচ এখন তাদের ফিরে যাওয়ার দরকার। যখন প্রয়োজন হয়েছিল তখন আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে, তাদের আজীবন ধরে রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবী নিজেই এক বিরাট সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মুহূর্ত পাড়ি দিচ্ছে এই মুহূর্তে। বছর বছর রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নেওয়ায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সংখ্যাও। ফলে যত বছর পার হবে তত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যা বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি করবে। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেকবার উঠছে। কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু আসেনি। পৃথিবীর যে কয়েকটি দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য কোনো দেশে আশ্রয় নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মিয়ানমার থেকে আসা মানুষ যারা রোহিঙ্গা নামে এদেশে বসবাস করছে।  

এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে, তাদের সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পার হচ্ছে। মাঝে মধ্যে রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু কথা শোনা গেলেও মূল সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এদিকে ক্রমেই এ দীর্ঘ বিষয়টি আর দীর্ঘতর হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনাটি ছিল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। এখন তাদের নিজদেশে ফিরিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রোহিঙ্গা সংকট এখন বিশ্বের অন্যতম বড় মানবিক সংকট। তবে এর সমাধানে শিগগিরই কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং সমস্যা দীর্ঘতর হচ্ছে। দিন দিন রোহিঙ্গা ইস্যুটি সরকারের জন্য বাড়তি বোঝা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি বারবার উঠলেও সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বের হচ্ছে না। বরং নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে বের হতে হলে, সমস্যার স্থায়ী সমাধান অর্থাৎ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে।
 

 

আরবি/জেআই

Link copied!