ঢাকা রবিবার, ০৫ জানুয়ারি, ২০২৫

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যর্পণে দরকার বৈশ্বিক সহযোগিতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২৫, ০৪:৫২ পিএম

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যর্পণে দরকার বৈশ্বিক সহযোগিতা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রোহিঙ্গারা হলো, মিয়ানমারে একটি জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ। যারা মূলত বহু বছর ধরে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে। তারা মিয়ানমারের বাঙালি-বংশোদ্ভূত মুসলমান এবং তাদের অধিকাংশই বাংলা বা বাংলার কাছাকাছি ভাষায় কথা বলে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার জান্তা সরকার দীর্ঘদিন নাগরিক অধিকার এবং মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এই কারণে তারা প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় নির্যাতন এবং জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে মিয়ানমারে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

২০১৭ সালে মিয়ানমার জান্তা সরকারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ও নিপীড়নের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা ঝাঁকে ঝাঁকে নাফ নদ সাঁতরে পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে আট লাখ রোহিঙ্গা ঢুকেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েক মাসে’। বাংলাদেশ সরকার মানবতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দেয়।

সম্প্রতি শরণার্থী জীবন থেকে মুক্তি পেতে নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবং নিজ দেশে ফেরার দাবিতে গণসমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যুবকদের সংগঠন ‘ইসলামি মাহাসা’ নামের একটি সংগঠনের উদ্যোগে এ সমাবেশ আয়োজন করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশও এর স্থায়ী সমাধান চায়।

রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে উচ্ছেদের মূল কারণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। তাদের পরিচয় এবং নাগরিকত্ব বিষয়ে মিয়ানমার সরকার সঠিক ব্যবস্থা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি, ফলে তারা অনেক সময় নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের ভিনদেশি বা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মনে করে। তাদের নাগরিকত্ব প্রদান বা তাদের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে রোহিঙ্গাদের দাবি তারা ওই ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা।

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস বহু পুরোনো। অতীতে তারা আরাকান রাজ্যে বাস করত। যা বর্তমানে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্য। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে, আরাকান রাজ্যের মুসলিম শাসকরা রাজ্য পরিচালনা করত। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন। ১৮২৪ সালে, প্রথম ইংরেজ-মিয়ানমার যুদ্ধের পর, আরাকান ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। এই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মুসলিম, হিন্দু এবং অন্য মানুষ আরাকানে যাওয়া শুরু করে। যাদের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম অন্যতম। ব্রিটিশ শাসনকালে শ্রমজীবী কিছু মানুষ গেলেও, অনেকেই ওখানকার স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এরপর ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় আরাকান মুসলিম নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এ বিষয়ে উদাসীন থাকেন। যার কারণে আরাকান দখল করে বার্মিজ বৌদ্ধ শাসকরা। এতে করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশ অধীনের রাজ্যটির দখল নেয় মিয়ানমার। এরপর আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন নাম রাখে মিয়ানমার। যদি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাখাইনকে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ করত তাহলে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দারা আজ সংখ্যালঘু, নির্যাতিত ও নিপীড়িত।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জাতিগত নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অন্য বাহিনী তাদের ওপর অত্যাচার, ধর্ষণ, হত্যা এবং বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেওয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এই নির্যাতনের ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আর অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভূমি ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। অনেকেই বাংলাদেশসহ অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। যেখানে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন। শরণার্থী শিবিরগুলোতে খাবার, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ সীমিত, ফলে তাদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টকর। রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুবই নাজুক। তাদের অধিকাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছে। সবচেয়ে সমস্যা হলো, এরা শিক্ষায় অনগ্রসর ও অসচেতন। আধুনিক  ও বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাপনে অনাগ্রহ। তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যেখানে দারিদ্র্য তাদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এদেশে রোহিঙ্গারা সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এটা স্বাভাবিক। মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করেছে। ফলে তারা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত, এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংকটের সমাধান প্রয়োজন।

রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর থেকেই বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশটি। বাংলাদেশ একটি জনবহুল রাষ্ট্র। বাংলাদেশের তুলনামূলক ছোট আয়তনের মধ্যে একটি বিশাল জনসংখ্যার মানুষ বসবাস করছে। যার ফলে জমির অভাব, শহরের ওপর অতিরিক্ত চাপ, এবং জীবনযাত্রার মানে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশে শ্রমবাজারে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। এর ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে যাচ্ছে এবং এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়ছে। নিজ দেশের জনসংখ্যার সমস্যা নিয়েই জটিল সমস্যায় ভুগছে বাংলাদেশ। এরই মাঝে বিশাল জনসংখ্যার রোহিঙ্গা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। প্রথম দিকে বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা এলেও বর্তমানে তা সীমিত। ১২ লাখের অধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর হেঁসেল চালানো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসন একটি অত্যন্ত জটিল এবং সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তবে, কূটনীতিকদের মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত চাপ ও সমর্থন রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষত, আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং মিয়ানমারের সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এই প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন তখনই সম্ভব, যখন মিয়ানমার সরকার তাদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার, নাগরিকত্ব এবং মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করবে, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সহাবস্থান নিশ্চিত করবে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সক্রিয় ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন। তবে সঠিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব। এক্ষেত্রে, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না হলে, তাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং স্থায়ী পুনর্বাসনও কঠিন হয়ে পড়বে।

আরবি/জেআই

Link copied!