একটা অস্থির সময়ে বসে সমাজের সুস্থতা নিয়ে ভাবনা লিপিবদ্ধ করা সত্যিই কঠিন। ১৯৭২ সালে আমাদের সামনে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের একটা নতুন প্রভাতের সামনে দাঁড় করিয়েছিল। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে ধারণ করে আমরা দেশবাসী আন্তরিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আগামী দিনগুলোয় সব দুঃখ-কষ্ট আমরা সমানভাবে ভাগ করে নেব। সংবিধানে লিপিবদ্ধ হওয়ার আগেই আমরা স্থির করেছিলাম সমাজে কোনো বৈষম্য থাকবে না, ধর্মকে আমরা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে দেব না, পরিবার ও সমাজে আমাদের যুগ যুগ ধরে ধারণ করা মূল্যবোধগুলোকে সমুন্নত রাখব।
কিন্তু অল্প দিনের মাথায়ই আমাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমরা দেখতে পেলামদেশটার বদল হয়েছে, কিন্তু আমরা বদল হইনি। সমাজে আবার দুর্নীতি দেখা দিল। কিছু মানুষের লোভের কাছে আমরা পরাজিত হলাম। সমাজের সিংহভাগ মানুষ নীরব বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করল, দ্রুত অর্থ-বিত্ত লাভের কদর্য প্রতিযোগিতা। সেই লোভ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সমাজের অভ্যন্তরে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় আমরা রোধ করতে পারলাম না।
আজ মনে পড়ছে ১৯৭৪-এর এপ্রিলে মঞ্চস্থ থিয়েটারের নাটক আবদুল্লাহ আল-মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’র কথা। স্কুলশিক্ষক বাবা তার সন্তানদের শিখিয়েছিলেন ‘সততাই মহৎ গুণ, লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে এবং সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে।’ সন্তানেরা বাবার লালিত মূল্যবোধগুলো নিয়ে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখে, তখনকার বাস্তবতায় তা অর্থহীন হয়ে গেছে। বাবার আদর্শ আঁকড়ে ধরে তারা জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়েছে। তাই তারা সততাকে বিসর্জন দিয়ে বেছে নিয়েছে অসৎ পথ। কন্যা অসৎ পথে যেতে রাজি না হওয়ায় স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে। শেষ দৃশ্যে আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বাবার প্রশ্ন ‘সত্য কি অচল হয়ে গেছে? জ্বলছে শুধু মিথ্যার হুতাশন?’ আপাতদৃষ্টিতে সমাজে মিথ্যার উল্লাস পরিলক্ষিত হলেও, শেষ বিচারে সত্যেরই জয় হয় এ বিশ্বাস এখনো আমরা হৃদয়ে ধারণ করি।
মূল্যবোধ শিক্ষার প্রধান জায়গা দুটো পরিবার এবং শিক্ষায়তন। কিন্তু অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি মা-বাবা বা বয়োজ্যেষ্ঠরা শিশুদের মূল্যবোধের শিক্ষা তেমন দেন না। অনেকেরই সন্তানের দিকে নজর দেওয়ার সময়ই নেই। নিজেরাই সন্তানের সামনে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছেন না। ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি কর্মজীবন শুরু করি একটা বড় মস্ফল কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। কলেজটির একটি দুর্নাম ছিল, ওখানে পরীক্ষায় নকল বেশি হয়। তরুণ অধ্যাপক হিসেবে নকলের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলাম। দেখলাম, পরীক্ষার সময় জানালা দিয়ে পরীক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করা হচ্ছে। সরবরাহকারীদের মধ্যে অভিভাবকরাও আছেন। আমি এবং আমার আরেক তরুণ সহকর্মী লম্বা লাঠি নিয়ে সরবরাহকারীদের তাড়া করলাম। তখন শিক্ষক হিসেবে আমাদের সাহস ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। আজকের দিনে এমন লাঠি নিয়ে তাড়া করলে তারা আমাদের মাথায়ই সে লাঠি ভাঙত! যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয়। আমার কথা হচ্ছে সন্তানকে নকল সরবরাহ করে একজন অভিভাবক কী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন? তরুণটি কী শিক্ষা পেল?
দীর্ঘদিন ধরে অন্যায় সহ্য করতে করতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন মানুষ সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলন কেবল কোটা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল না, বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে যে বিরাজমান বৈষম্য তার বিরুদ্ধে ছিল এ গণজাগরণ। বঞ্চিত মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরিত হলো। এক লহমায় বদলে গেল দৃশ্যপট।
যে ভয়ের সংস্কৃতি সমাজকে গ্রাস করেছিল, তা এখনো সম্পূর্ণ দূর হয়েছে বলে আমরা মনে করি না। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি খর্ব করা হয়, তবে আমরা ফিরে যাব সেই অন্ধকার সময়ে।
সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে আতঙ্কজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা কোথায় গিয়ে শেষ হবে ভাবতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে, অনেক শিক্ষকের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটছে। এই অবস্থার জন্য শিক্ষকেরাও যে অনেকাংশে দায়ী, তা অস্বীকার করব না। অন্ধ দলদাস হওয়া কোনো শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশিত নয়। তবে শিক্ষকের যদি এমন অমর্যাদা হয়, তবে ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কী রূপ নেবে বলতে পারি না। ছাত্র-শিক্ষকের এমন সম্পর্ক নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যাশা করি না।
এ ধরনের হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যে একটা বড় আশার আলো খুঁজে পাই যখন দেখি বন্যার্তদের ত্রাণসহায়তায় সমাজের সব স্তরের মানুষ তাদের সাধ্যমতো এগিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ যে ত্রাণকেন্দ্র স্থাপন করেছে, তাতে নাগরিক সমাজের যে অভূতপূর্ব সাড়া, তা এক কথায় আশাজাগানিয়া। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ কথাটা আবারও প্রমাণিত হলো। শিশুরাও বড়দের দেখাদেখি মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। পরিবারের কাছ থেকে এই শিক্ষাই তো আমরা চাই।
একই ধরনের মানবিকতার প্রমাণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম কোভিড অতিমারির সময়ে। মানুষ সাধ্যমতো এগিয়ে এসেছিলেন দুর্দশাগ্রস্তদের সহায়তা করার জন্য। এ মানবিক আচরণ কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, পশুপাখিরাও বাদ যায়নি মানুষের সহানুভূতি থেকে। আমরা ভেবেছিলাম, এ ধারা অব্যাহত থাকবে কোভিড পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আবার আমরা আগের রূপেই ফিরে গেলাম।
আমাদের সমাজের একটা বড় সংকটের জায়গা পরমত সহিষ্ণুতার অনুপস্থিতি। রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র আমরা অন্যের মতকে সহ্য করতে পারি না, শুনতেও চাই না। যুক্তিতর্কের চেয়ে পেশি ও ক্ষমতার জোর বেশি। এটা তো কোনো সভ্য সমাজের পরিচয় হতে পারে না।
একই সঙ্গে অন্যের ধর্মবিশ্বাস এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমরা দেখতে পাই না। এসব শিক্ষা পরিবার থেকেই দেওয়া উচিত এবং শিক্ষায়তনে তা গুরুত্বের সঙ্গে কিশোর মনে গেঁথে দেওয়া কর্তব্য বলে আমরা বিবেচনা করি। তাহলে পরবর্তীকালে এর সুফল আমরা প্রত্যক্ষ করব।
একটা কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সত্যিকারের ধার্মিক মানুষ কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। সমাজের সর্বস্তরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করতে পারলে, এদেশটা এগিয়ে যাবে, সব মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায়।
আজ আমরা সবাই পরিবর্তন প্রত্যাশী। সমাজ পরিবর্তিত হলে দেশ পরিবর্তিত হবে। নিজেদের বদল না করে আমরা রাষ্ট্রকাঠামোর বদল কী করে করব? আজও যদি আমরা তা করতে না পারি, তবে ১৯৭১-২০২৪ পর্যন্ত যত আত্মাহুতি, যত ত্যাগ সব ব্যর্থ হয়ে যাবে।
নাট্যজন ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আপনার মতামত লিখুন :