ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিশ্বে সাংবাদিকদের সাহসিকতার চিত্র আশাব্যঞ্জক

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২৪, ১০:১০ পিএম

বিশ্বে সাংবাদিকদের সাহসিকতার চিত্র আশাব্যঞ্জক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকা: আপসকামিতা নিয়ে অনেক মুখরোচক কাহিনি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়। তবে আপসহীন আত্মত্যাগী সাংবাদিকতা নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা নেই। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার প্রেক্ষাপটে মুদ্রার ওই অন্য পিঠের অসম সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ নিয়ে লেখা। তবে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১১৩ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে; যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি। গণমাধ্যমকর্মীদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠা যা নিয়ে বহুদেশে ও বহুক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছে বারবার। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পূর্বে ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের অনেক কর্মীর সাহসিকতা, নৈতিকতা, অপশক্তিকে রুখে দাঁড়িয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া, জীবন-জীবিকা বিপন্ন করে সত্যনিষ্ঠ থাকার সংগ্রামী ঘটনাও আছে। 

বিবিসি ওয়ার্ল্ডের খবরে ফিলিস্তিনিদের নিহত হওয়ার ঘটনাকে ‘মারা যাওয়া’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ইসরায়েলিদের ক্ষেত্রে ‘নিহত’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা ‘প্রতিরোধ’ শব্দটিকে শুধু ইসরায়েলি সেনাদের জন্য বরাদ্দ রেখেছে। বিবিসির একজন সাংবাদিকও নেই, যিনি ইসরায়েলি সেনাদের গণহত্যা চালানোকে ‘প্রতিরোধ’ হিসেবে বর্ণনা করতে দ্বিধা করবেন। বিশ্বনেতাদের বড় অংশই ‘মুখ খোলার বিষয়ে’ কোনো ধরনের চাপের মুখে নেই। কারণ, মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের কোনো বক্তব্যকে সমালোচনার দৃষ্টি দিয়ে দেখছে না। আন্তর্জাতিক আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইসরায়েলের চালানো তৎপরতাকে তারা স্থূলভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।  চ্যানেল ফোর টিভির সাংবাদিক যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিনকে হামাসের ‘নিন্দা’ জানাতে বলেছিলেন। ওই সময় তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদেরও মানবাধিকার নিশ্চিত করা উচিত বলে মন্তব্য করার পর সাংবাদিক ভদ্রলোক তাঁকে ‘ইহুদিবিরোধী’ কোনো মন্তব্য না করার জন্য সতর্ক করে দেন। গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের দূত হুসাম জোমলোতের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিবিসির সাংবাদিক তাঁকে বারবার হামাসের নিন্দা জানানোর জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ভাবটা এমন ছিল, যেন তিনি নিন্দা না জানালে তা সন্ত্রাসকে সমর্থন দেওয়ারই নামান্তর হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিবিসি ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁকে নেতানিয়াহুর নির্বিচার বোমাবর্ষণের আদেশ দেওয়ার বিষয়ে নিন্দা জানাতে বলেননি।

বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ভূখণ্ড গাজা। চারদিক থেকে ঘিরে রাখা ‘উন্মুক্ত জেলখানা’ গাজা। তার ১০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু ও অক্ষমেরা যখন মৃত্যুভয়ে পালাচ্ছেন, তখনো তাঁদের ওপর আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে বোমাবর্ষণ করে মারা হচ্ছে। হামাসের হামলায় ১ হাজার ৩০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েল এই নজিরবিহীন হামলা চালাচ্ছে। ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যা অভিযান নির্বিঘ্নে চলমান। ৭ অক্টোবরের পর থেকে তাদের এ হত্যাযজ্ঞের শিকার ৪১ হাজারের বেশি নিরস্ত্র মানুষ। ইসরায়েলি জায়নবাদী চক্র মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই তাদের ভয়াবহ আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। তবে ইসরায়েলি গণহত্যাকারীরা অন্তত একটি বৈশ্বিক শক্তির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে তা হলো গণমাধ্যমের একাংশ। যদিও এ কথা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশটাই এ গণহত্যার পক্ষে কাজ করছে। তবুও গণমাধ্যমের একাংশ ও অকুতোভয় সাংবাদিকদের অনেকে জীবনবাজি রেখে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন তা ব্যতিক্রমী ও দৃষ্টান্তমূলক। আগামী দিনের জন্য আশাব্যঞ্জক। এই বর্ণবাদবিরোধী, জায়নবাদবিরোধী ও উপনিবেশবিরোধী সাংবাদিকেরা এখন ইসরায়েলি যুদ্ধবাজদের জন্য এক বড় মাথাব্যথার কারণ।

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান আগ্রাসনে সাহসিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করায় ২০২৪ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রাথমিক তালিকায় ৪ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মনোনীত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি এই চার সাংবাদিক হলেন- আলোকচিত্রী মোতাজ আজাইজা, টিভি সাংবাদিক হিন্দ খৌদারি, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী বিশাস ওউদা এবং বর্ষীয়ান সাংবাদিক ওয়ায়েল আল-দাহদৌহ। উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েল হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। নিহত হয়েছেন ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। এই চার সাংবাদিক তাদের প্রকাশিত সংবাদ ও ছবিতে গাজায় চলতে থাকা নৃসংশতা এবং নিগ্রহের চিত্র পাঠক ও শ্রোতা-দর্শকদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছেন। বিশ্বে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা ব্যক্তি ও সংগঠনকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য নরওয়েভিত্তিক নোবেল কমিটি এ পর্যন্ত ২৮৫ জনের মনোনয়ন গ্রহণ করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১৯৬ ব্যক্তি ও ৮৯টি প্রতিষ্ঠান। এ বছরের বিজয়ীর নাম ঘোষণা হবে ১১ অক্টোবর। ১০ ডিসেম্বর হবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।

জায়নবাদী মিথ্যার মুখোশ খুলে দিতে অনেক সাংবাদিক মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। সত্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য ইসরায়েলের যুদ্ধমেশিন এসব সাংবাদিককে পুরস্কার হিসেবে দিচ্ছে মৃত্যু। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) হিসাব মতে, এ পর্যন্ত ১১৩ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। ৩২ জন আহত, ২ জন নিখোঁজ এবং ৫২ জন বন্দি ও নির্যাতিত হয়েছেন। সম্প্রতি ৩১ জুলাই আলজাজিরায় কর্মরত দুজন সাংবাদিক ইসমাইল আল গুল ও রমি আল রেফি এবং আল রিসালার সাংবাদিক আবু জাসের ইসরায়েলি হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। তারা ৩ জনই ফিলিস্তিনি নাগরিক। জাসেরের সঙ্গে তার মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানও খুন হন। ইতিপূর্বে ইয়াসির কাদিহ ওওয়ায়েল আল দাহদোহ তাদের পরিবারের যথাক্রমে ৮ ও ৪ জন সদস্যকে হারিয়েছেন। জীবন বিপন্ন করে কর্মরত এসব সাংবাদিককে ইসরায়েল নির্লজ্জভাবে হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়। তারপরও সত্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতার জন্য ৪ ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মনোনীত হয়েছেন ২০২৪ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রাথমিক তালিকায়।

 

সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ
 

আরবি/জেডআর

Link copied!