দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে বাংলা (বাংলাদেশ) সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল তার ভৌগোলিক অবস্থান, সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং উর্বর ভূমিতে উৎপন্ন সোনালি ফসল ও প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য।
বর্তমান বিশ্বে বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং মাথাপিছু জিডিপিতে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গ। অথচ, দিল্লি সালতানাত এবং শাহী বাংলার সুলতানদের সময় (১২০৬-১৫২৬ খিষ্টাব্দ) ইউরোপীয়রা বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বাণিজ্যিক দেশরূপে গণ্য করত। মুঘল আমলে বাংলা ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী। মুঘল আমলে বাংলা ছিল মসলিন, সিল্ক এবং মুক্তা বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। ঢাকা ছিল সিল্ক শাড়ির জন্য বিখ্যাত। এ প্রদেশ বস্ত্র শিল্প, জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদনের ( জিডিপির) ১২ শতাংশ উৎপন্ন হতো সুবাহ বাংলায়। যা সে সময় সমগ্র ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের চেয়ে অধিক ছিল। অথচ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশকে এখন দরিদ্র দেশ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বিদেশি ঋণ সহায়তা ছাড়া বর্তমানে আমাদের চলা অকল্পনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। পারস্য, আরব, ভূ- মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে বাংলায় দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। বাংলা বিভিন্ন শাসকদের শাসনামলে রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে।
চতুর্দশ শতকে (১৩৪৬) মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলা সফর শেষে তার গ্রন্থে বাংলার পরিচয় দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, তখন বাংলায় এক মণ ধানের দাম ছিল তিন পয়সা। এক মণ চালের দাম ছিল এগারো পয়সা। এক মণ চিনি পাওয়া যেত দেড় পয়সায়। সতেরো শতকে সুবাহ বাংলার বিখ্যাত সুবেদার শায়েস্তা খাঁ তার ২২ বছরের শাসনামলে বাংলার ব্যাপক উন্নতি করেন এবং তার আমলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। অথচ এসব কিছু এখন আমাদের কল্পনাতীত। এমন একটা অবস্থানে এসে আমরা উপনীত হয়েছি যেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে জর্জরিত আমাদের দেশের একটা বিরাট অংশ।
বাংলাদেশে বিদ্যমান দারিদ্র্য, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণ হিসেবে ‘ঘনবসতিপূর্ণ ও বিপুল জনসংখ্যা’কে চিহ্নিত করা হয়। অথচ, জাপান বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়েছে। জনসংখ্যায় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ চীন তার বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরে ঘটিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হয়েছে আর এটা সম্ভব করতে চীনের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। কেবল শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন। একটি দেশের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ কখনোই তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন বা সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারে না। দরিদ্র, দুর্ভিক্ষপীড়িত, সুবিধাবঞ্চিত, নিপীড়িত মহাদেশ আফ্রিকা যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভার থাকা সত্ত্বেও ক্ষুধার রাজ্যে বসবাস করতে হয় দেশটির বেশিরভাগ জনগণকে। নিরক্ষরতার অভিশাপ যেন তাদের জীবনকে হীরক রাজা থেকে হীরক খনির মজুর বানিয়েছে ।
দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি গণতান্ত্রিক নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘শিক্ষার মাধ্যমে নিজের, সমাজ, দেশকে তথা বিশ্বকে পরিবর্তন করা সম্ভব।’ শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব একটি জাতিকে মানবসম্পদে রূপান্তর করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে জিডিপির ২ শতাংশও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা হয় না। যেখানে উন্নত দেশগুলোতে ইউনিসেফের পরামর্শ অনুযায়ী জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা হয়। শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের দেশে শিক্ষা শুধু পুথিগত বিদ্যা অর্জন ও সনদ লাভের মধ্যেই আবদ্ধ। যার ফলাফল স্বরূপ আমরা পাচ্ছি তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ এবং বিরাট বেকার জনগোষ্ঠী।
বর্তমান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যে বয়সে বাচ্চাদের শেখানো হয় অনুকূল পরিবেশ খাপ খাওয়ানোর দক্ষতা, নিজের কাজ নিজে করার ক্ষমতা; আমাদের দেশে সে বয়সে বাচ্চাদের মুখে তুলে খাবার খাওয়ানো কিংবা স্মার্টফোন, টেলিভিশনে আসক্ত করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে যে বয়সে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল মেধার বিকাশ ঘটে শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিজ্ঞান ল্যাবে, আমাদের দেশে সে বয়সে শিক্ষার্থীদের কিছু নোটশিট মুখস্থ করানো হয় ক্লাসে এ প্লাস প্রাপ্তি কিংবা প্রথম অবস্থান লাভে। যে বয়সে তারা নতুন নতুন ব্যবসায়িক উপায় খুঁজে বা নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে সে বয়সে আমাদের দেশে হন্যে হয়ে চাকরির দ্বারে দ্বারে ঘোরে। তাই তো আমাদের দেশে ইলন মাস্কের মতো উদ্যোক্তা বা নিউটন, আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী তৈরি হয় না।
বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। এই প্রযুক্তিনির্ভর যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ এবং আগামী প্রজন্মের সৃজনশীল মেধা উন্মেষে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্য বিমোচনে, বেকারত্ব দূরীকরণে শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
আপনার মতামত লিখুন :