ঢাকা শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪

ঋণের ফাঁদ ও দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৪, ১০:৫৩ এএম

ঋণের ফাঁদ ও দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

একটা দেশ কীভাবে ঋণের ফাঁদে পড়ে তার একটা উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে ব্যাংক, শেয়ারবাজার, বৃহৎ প্রকল্প সব কিছুর আড়ালে দুর্নীতির বিশাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। শিক্ষা নেওয়ার কথা এলে সবাই বলেন অতীত থেকে শিক্ষা নাও। 
গত সরকারের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক খাত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফলে শিক্ষা নিতে হবে অতীতের ভুল থেকে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া হয়েছিল যার বোঝা একটা বড় বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যে কোনো দেশের সরকারের জন্য ঋণের উৎস প্রধানত ২টি। একটি অভ্যন্তরীণ ঋণ ও অন্যটি বৈদেশিক ঋণ। অভ্যন্তরীণ ঋণ বেশি নিলে বিনিয়োগকারীরা ঋণ নিতে পারে না আর বৈদেশিক ঋণ বেশি হলে নানা ধরনের শর্তের জালে আটকা পড়তে হয় দেশকে। তাই ঋণ সেটা অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক যা-ই হোক না কেন দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই। ফলে দেশ এবং জনগণের কথা ভাবলে সতর্কভাবেই ঋণ নেওয়া উচিত।

বিগত বছরগুলোয় আওয়ামী লীগ সরকার যে ঋণ করেছে, তার বড় একটা অংশ এসেছে দেশীয় উৎস থেকে। দেশীয় উৎসের মধ্যে বেশিরভাগ ঋণ করা হয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, পদত্যাগের সময় শেখ হাসিনার সরকার ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ রেখে গেছে। এ ঋণ পরিশোধের দায় বর্তেছে বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। শুধু যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ ঋণের দায় বহন করতে হবে তা নয়, পরবর্তীকালে যেসব সরকার আসবে, তাদেরও এ দায় বহন করতে হবে। সরকার আসবে সরকার যাবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঋণের এই বোঝা দেশের জনগণকেই বহন করতে হবে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বলা হতো, ভারতের কৃষকরা  হলো সেই হতভাগা, যারা ঋণের মধ্যেই জন্মে এবং মরে।

আজ বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। সরল হিসাবেও দেখা যাচ্ছে আজ যে শিশুর জন্ম হবে, তার মাথার ওপর থাকবে কমপক্ষে ১ লাখ টাকার ঋণের বোঝা। বেঁচে থাকলে ঋণের বোঝা টেনে চলতে হবে এবং মৃত্যুতেও এ ঋণের দায় থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না। একটি জাতির জন্য এ রকম ঋণের বোঝা কতটা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে, তা কি সরকার ভাববে না? ব্যাংক থেকে এবং বিদেশ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে এই দায়িত্বশীলতার প্রশ্নটাই এখন বিতর্ক তৈরি করছে।  

দেশ পরিচালনা করতে, নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে টাকা তো  লাগবে। এই টাকার পুরোটা দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগ্রহ করতে না পারলে ঋণ নিতেই হবে। কিন্তু কি শর্তে এবং কী পরিমাণ ঋণ নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে সঠিক বিশ্লেষণ জরুরি। তা না হলে অপ্রয়োজনীয় ঋণ এবং ঋণের কঠিন শর্ত অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে। উন্নয়নের মোহ তৈরি আর লুণ্ঠনের মহোৎসবের ফলে দেশীয় এবং বিদেশি সকল উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়েছে বিগত সরকার। অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ মনে করেন দেশের অভ্যন্তর থেকে সরকারের ঋণ কম নেওয়াই উচিত। তারা তাই বিদেশি মুদ্রায় ঋণ করাকে ভালো মনে করেন। কিন্তু যদি বিচার বিবেচনা না করে বিদেশি ঋণ না নেওয়া হয় তাহলে যে তা গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও তার প্রমাণ আছে। ঋণের সুদ এবং আসল শোধ দিতে বাজেটের বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। আর শর্ত মানতে গিয়ে গ্যাস বিদ্যুৎ পানির দাম বাড়াতে হয়েছে বারবার।  

উন্নয়ন না গণতন্ত্র এই আওয়াজ তোলা হয়েছিল আর উন্নয়নের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকার কঠিন শর্তেও বিদেশি ঋণ নিয়েছে। যথার্থ প্রয়োজন নিরূপণ না করে ও বাছবিচার না করে ঋণ নেওয়ার ফলে সরকারের দায়-দেনা বেড়েছে বিপুল। অর্থনীতিতেও সহ্যক্ষমতা বিবেচনা করতে হয়। এই বিবেচনায় ঋণ পরিস্থিতি প্রায় সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।  অর্থ বিভাগ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ঋণের স্থিতি ১৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা।  নিয়ম অনুযায়ী ঋণের হিসাব হাল নাগাদ করা হয় প্রতি ৩ মাস অন্তর। সেই হিসাবে মার্চ, জুন শেষে ঋণের স্থিতি হয়েছে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তর থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ হবে ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা, আর বিদেশি ঋণের পরিমাণ হবে ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসের শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৭৯০ কোটি মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১১৮ টাকা দরে হিসাব করলে তা ৮ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা দাঁড়ায়। কিন্তু বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে প্রতি ডলারের মূল্য ১২১ টাকা।  সুতরাং, দেশীয় মুদ্রার মূল্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৮ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য।  

টাকার অংকে যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যায় যে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের  স্থিতি দেশের  অতীতের ৩টি বড় বাজেটের সমান। বিপুল পরিমাণ ঋণ শোধ এবং সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে বাজেটের ওপর ভীষণ চাপ পড়বে। বড় বাজেটের আত্মপ্রসাদ লাভের মানসিকতা গড়ে তোলা হয়েছে অতীতের বছরগুলোতে। এর  ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে আগামী বাজেটের সময় আরও ঋণ করতে হবে, অর্থাৎ বাজেটে ঋণ সহায়তা প্রয়োজন হবে। এসব ঋণ চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। ঋণ নেওয়া, ঋণের সুদ দেওয়া, আসল পরিশোধ করা, আবার ঋণ নেওয়া বিষয়টি এমনভাবে চলতে চলতে ঋণের ফাঁদে পড়ে যায় দেশ। ফলে সাবধান থাকতে হয় যেন ঋণ গ্রহণ অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে চলে না যায়। 
আওয়ামী লীগের প্রায় ১৫ বছরে গড়ে ওঠা কয়েকটি অলিগার্ক গোষ্ঠী ফুলে-ফেঁপে বিশাল আকার ধারণ করেছিল।

এরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়  ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ করেছিল পরিশোধ না করার জন্য। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরা ব্যাংক দখল করেছিল ব্যাংকগুলোকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য। প্রভাব খাটিয়ে রি-শিডিউল করার নামে এমন সব নিয়ম চালু করেছিল, যার ফলে ঋণ পরিশোধ না করেও ঋণখেলাপি হতে হয়নি।  কিন্তু এর ফলে বেশকিছু ব্যাংক নিরাময় অযোগ্য রোগে রুগ্ণ হয়ে পড়ে। পদ্মা ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংক তৈরি করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের আমানত লুটপাট করার জন্য। কিছু ব্যাংকের অ্যাডভান্স টু ডিপোজিট অনুপাত এতটাই নেতিবাচক অবস্থায় পড়েছে যে,  আমানতকারীদের চেকের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে তারা। অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তাদেরকে অন্য ব্যাংক বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।  

একটু পেছনে তাকানো যাক! আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু যখন ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হলো, তখন দেখা যাচ্ছে গোটা ঋণ পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে। ঋণের পরিমাণ ৬ গুণ বেড়েছে, এমনকি বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ নিয়েও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।  

কিন্তু এই সংকটের সমাধান তো করতে হবে। ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা, মেগা প্রকল্পের মোহ পরিত্যাগ করা, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো, যাচাই করে ঋণ নেওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ। লুণ্ঠনমূলক অর্থনীতি সমাজে বৈষম্য বাড়ায় কাজেই এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যে অভ্যুত্থান হয়েছে তার ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি যেন নতুনভাবে গড়ে ওঠে এ আকাক্সক্ষা মানুষের আছে। দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করা সহজ, কিন্তু দুর্নীতির যে চক্র গড়ে উঠেছে  তা ভাঙ্গার কঠিন কাজটা এখন জরুরি। সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া এবং আস্থার পরিবেশ তৈরি করার ওপর অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো নির্ভর করছে। ব্যাংক ব্যবস্থার শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা আর রাজনীতিতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে।   
 

আরবি/জেআই

Link copied!