মশাকে অবজ্ঞা করার আমাদের যথেচ্ছ অভ্যাস থাকলেও তা মোটেও ঠিক নয়, মশা কিন্তু নিরীহ প্রাণী নয়। এই মশা-ই লাখ লাখ সৈন্যকে পৃথিবীর প্রথম স্বৈরাচার (ইসলাম ও ইহুদি ধর্মমতে) নমরুদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা গেল পুরোনো কথা। আজকের যুগে সেই মশা-ই জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াসহ জীবাণুবাহক মশা নামক মারাত্মক এই কীট ১ সেকেন্ডের মধ্যে প্রায় ৩শ’ থেকে ৬শ’ বার পাখা ঝাপটিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১ থেকে দেড় মাইল উড়ে যেতে পারে। আর সামান্য এক কামড়ে মুহূর্তেই রোগজীবাণু ছড়িয়ে দিতে পারে এক থেকে আরেক জনের শরীরে।
আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যান বলছে, মশার কারণে প্রতিবছর পৃথিবীর ৭০ কোটির মতো মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে মারা যায় ১০ লাখেরও বেশি।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ৩ হাজার ৫ শ’য়েরও বেশি প্রজাতির মশা পাওয়া গেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এডিস মশার জন্ম চার শ’ বছর আগে আফ্রিকায়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সব এলাকায়। মাঝারি আকারের এই মশার দেহে সাদা-কালো ডোরাকাটা দাগ থাকে বলে একে টাইগার মশাও বলা হয়ে থাকে। একসময় আমরা স্লোগান দিতাম মশায় ভরা ঢাকা।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে থিসিস গ্রুপের শিক্ষার্থী হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদিয়া আহমেদের তত্ত্বাবধানে প্রখ্যাত কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর অধীনে ২০০২ সালজুড়ে ঢাকার বনানীতে একটি প্রতিষ্ঠানে আমাদের কয়েকজনের মশা নিয়ন্ত্রণে জৈব ও রাসায়নিক কীটনাশকের প্রভাব নিয়ে গবেষণা সম্পাদনের সুযোগ হয়। গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আমাদের মশার লার্ভা (শুককীট) সংগ্রহ ও পালনের মাধ্যমে জন্মানো মশা নিয়ে কাজ করতে হতো। আর মশার লার্ভা পাওয়া যেত নর্দমাযুক্ত ড্রেন থেকে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন বন্ধুটি প্যান্টের মধ্যে শার্ট ইন করে বুট জুতা পরে সাত-সকালে যখন নোংরা নর্দমা-ড্রেন হতে মশার লার্ভা সংগ্রহ করত তখন আশপাশে লোকজন জড়ো হয়ে যেত। সবার চোখে বিস্ময় কাজ করত এ রকম ফর্সা এক কিশোর (ওর বয়স একটু কমই দেখাত) নোংরা ড্রেন হতে কেন পানি নিচ্ছে? আর ওকে নানারকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলত। যতই ক্রোধ জন্ম নিক না কেন পাবলিক পরিসরে জনাকীর্ণ অবস্থায় চুপ করে থাকার মতো যথেষ্ট ধৈর্য ও অর্জন করেছিল। খালি মাঝে মধ্যে এড়াতে না পারলে ও হাসিমুখে উত্তর দিত- ‘মশার বাচ্চা সংগ্রহ করি’। দর্শনার্থীদের মধ্যে (শিক্ষিত কি শিক্ষাবঞ্চিত) অধিকাংশই পারলে হাসিতে গড়াগড়ি খেত; এই মনোভাব নিয়ে যে, মশা তো উড়ে উড়ে বেড়ায় আর ঘরে-বাইরে আমাদের কামড়ায়। ড্রেনের পানিতে আবার মশা আসে কীভাবে? যা-ই হোক খুব বেশি বোঝাতে চেষ্টা না করে ওর কাজ করে যেত।
প্রাসঙ্গিকভাবে উপরোক্ত বাস্তব ঘটনার উল্লেখ এই কারণে করা যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে বড় একটা অংশকে তখন মানানো যেত না যে, মশার জীবনচক্রে ডিম হতে জন্মানো লার্ভা থেকে পিউপা (মুককীট) হয়। আর এই পিউপা থেকে মশার জন্ম হয়। তার মানে জনসাধারণকে মশার উৎপত্তি সম্পর্কে সচেতন করা না গেলে মশা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ কীভাবে সম্ভব?
ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগের জীবাণুবাহক কিউল্যাক্স মশা, যা সর্বত্রই দেখা যায় ডিম পাড়ে নর্দমার ময়লা পানিতে, সেখানেই বেড়ে ওঠে।বাংলাদেশে বহু পুরোনো রোগ ম্যালেরিয়ার বাহক অ্যানোফিলিস মশা পুকুর বা ক্ষেত-খামারের পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে। তুলনামূলক কিছুটা এলিট এডিস মশা গাড়ির পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনে জমে থাকা পানি, ছাদের ওপরে বা বারান্দায় থাকা ফুলের টব, পরিত্যক্ত নারিকেলের মালা, ডাবের খোসা এমনকি ঘরের মধ্যে স্বল্প পরিমাণ পরিষ্কার পানি জমে থাকা কোনো পাত্রের গায়ে ডিম পাড়ে। আর তারপর সেই পানি যদি কয়েকদিন পরিষ্কার করা না হয় বা ফেলে দেওয়া না হয়, তবে সেখান হতে পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা জন্ম নেয়।
মশার ডিম থেকে পরিণত মশা হতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগে। পরিণত মশা মোটামুটি এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এডিস মশা ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা- এই তিনটি রোগ ছড়ায়। ১৯৯৯ সালে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় রাজশাহীর পবায়। ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে জিকা শনাক্ত হয়।
ফুলের রেণুর সুক্রোজ মশার প্রধান খাদ্য। কিছু মশা পচা জল, ফল, গাছের পাতা, কাণ্ড ও অন্যান্য উৎস থেকে খাদ্যরস সংগ্রহ করে। তবে স্ত্রী মশার ডিম নিষিক্তের জন্য নিউট্রিয়েন্ট সোর্স হিসেবে থ্রিওনিন নামক অত্যাবশকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিডপ্রাপ্তি এবং গর্ভাশয়ের পরিবেশ ঠিক রাখতে স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্তের প্রয়োজন হয়। তাই স্ত্রী মশা অনেকটা বাধ্য হয়েই ওদের সিরিঞ্জের মতো হুল (বিশেষ শুঁড়) দিয়ে মানুষসহ স্তন্যপায়ী প্রাণির রক্ত শুষে নেয়। কামড় দিয়ে অসুস্থ মানুষের রক্ত শুষে নেওয়ার সময় রক্তে থাকা জীবাণু মশার পাকস্থলীতে প্রবেশ করে। তারপর সেই জীবাণু সংখ্যায় বেড়ে মশার লালাগ্রন্থিতে অবস্থান করে। এই মশা কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ালে মশার লালায় থাকা জীবাণু সেই মানুষটির রক্তে প্রবেশ করে এবং তিনি রোগাক্রান্ত হন।
বাংলায় একটি প্রবাদ রয়েছে- ‘মশা মারতে কামান দাগানো’। আমাদের দেশে সেই কামান দাগানোর মতো মশা মারতে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করা হলেও মশার বংশবিস্তার রোধে এর কতটা প্রভাব, বাস্তব পরিস্থিতি দেখে তা সহজেই অনুমেয়! চলতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ডেঙ্গুতে ১০০ জনের বেশি মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এডিস মশার ভয়াবহতা সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য-উপাত্ত আপাতত আর দরকার নেই। নাগরিক জীবনে মশার উপদ্রব রাতারাতি দূর করা যাবে না। কাজেই শুধু ফাঁকা বুলি আওড়ানো কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে অপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ নয় বরং মশকনিধনে কার্যকর সমাধান বের করার জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, বিশেষত কীটতত্ত্ববিদদের প্রয়োজনীয় ও বাস্তবসম্মত নিত্য-নতুন গবেষণাকর্মে যথাযথ রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মশকনিধনে সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আরেকটি প্রয়োজনীয় কথা হলো, ওষুধ ছিটিয়ে সফলতা পেতে হলে উড়ন্ত মশা মারার লক্ষ্যে ফগিং কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি মশার লার্ভানিধনে জৈব ও অজৈব কীটনাশকের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আলাদা কর্মপন্থা নয়, বরং মশা নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বিত কর্মপন্থা নির্ধারণে মশা নির্মূলে যুগোপযোগী একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। আর এই নীতিমালা তৈরির লক্ষ্যে বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে (আইইডিসিআর) কাজে লাগানো যেতে পারে।
মশকনিধনে নাগরিকদের সচেতন করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করার পাশাপাশি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে প্রয়োজনে ব্যক্তি উদ্যোগে পরিমিত ও প্রয়োজনমতো রাসায়নিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে মশকনিধনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ওপর শুল্ক হ্রাস করা যেতে পারে।
সর্বোপরি মশা মারার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় মানসম্মত জৈব ও রাসায়নিক কীটনাশক সহজলভ্য ও সুলভ করা। মশা মারার সঠিক রাসায়নিক ও কার্যকর ডোজ নির্ধারণ, সঠিক অনুপাত অনুযায়ী রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে কি-না তা নিয়মিত মনিটরিং; প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং তা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা আবশ্যক। বদ্ধ নালা ও জলাশয় পরিষ্কার এবং শহরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সময়ে সময়ে শুধু লোক দেখানো কিছু কার্যক্রম বাস্তবায়ন নয়, বরং সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগে মশার ধরন, উৎপত্তি ও বংশবিস্তারের কাল বিবেচনায় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জাতের মশকনিধনে বছরব্যাপী সঠিক, সময়োপযোগী ও নিয়মমাফিক সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলে মশাবাহিত রোগ থেকে দেশবাসীকে নিরাপদে রাখা সম্ভব হবে।
আপনার মতামত লিখুন :