ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ সংস্কারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

কাজী মো. শফিউল আলম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৪, ০৩:০৭ পিএম

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ সংস্কারে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

কাজী মো. শফিউল আলম । ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং নোবেলজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর মো. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের দক্ষ, প্রাজ্ঞ ও যোগ্য পরিচালনায় স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় সংস্কার কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই স্থানীয় সরকারের  সব পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়েছে।

অভ্যুথ্যানের মাধ্যমে অতীতেও কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবর্তন বা পতন হলেও স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভা বিলুপ্ত করতে হয়নি। ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুথ্যানের ফলে বিগত সরকারের পতন হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯ আগস্টের আগ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারকে বিলুপ্ত করেনি। বরং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ কিছু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ দাপ্তরিক কাজ করেছেন মর্মে পত্রিকান্তরে জানতে পারি। কিন্তু দেখা গেছে, অভ্যুত্থানের প্রায় ১৩-১৪ দিন পরেও ৯৯.৯৯ শতাংশ নির্বাচিত প্রতিনিধি হয় পলাতক, অথবা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এমতাবস্থায় জনগণ নাগরিকসেবা থেকে বঞ্চিত।

দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে পারে না। অতীতে সরকার পতন বা পরিবর্তনে কখনো এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। এবার কেন হলো সে প্রশ্ন সামনে এসেছে। স্বাধীনতার পর থেকে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন ছিল নির্দলীয়। জনগণ ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বা আত্মীয়তার ভিত্তিতে অথবা দলমত নির্বিশেষে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচন করতে পারতেন। এ অবস্থায় সরকার পরিবর্তনের ফলে স্থানীয় সরকারে লেশমাত্র প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন টায়ার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ টায়ার তথা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কখনো দলীয় প্রতীকে, আবার কখনো সরকারদলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে দেখা গেছে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। বিগত নির্বাচনগুলোতে যেহেতু প্রধান ও বড় দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি সেহেতু সরকারি দলের আস্থাভাজন ব্যক্তিই প্রভাবশালী এবং তথাকথিত একমাত্র যোগ্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। কত শতাংশ  ভোটার ভোট দিলেন বা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হলো কি-না তা দেখার প্রয়োজন অনুভূত হয়নি। এভাবে নির্ধারিত প্রতিনিধি ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, দলীয় আনুগত্যের বাইরে গিয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ আছে কি? ‘নির্বাচিত’ প্রতিনিধি না বলে ‘নির্ধারিত’  প্রতিনিধি বলার কারণ হলো, স্থানীয় সরকারের অনেক পর্যায়ে বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদে সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ প্রার্থী হওয়ার সাহসও করেনি। এমন উপজেলাও আছে, ১৫টি ইউনিয়নের ১৫ জন চেয়ারম্যান এবং মেম্বারসহ ১৮০ জন সদস্যের সবাই ক্ষমতাবান দলের মন্ত্রী বা এমপি দ্বারা নির্ধারিত মনোনীত। এ পরিস্থিতিতে মনোনীত প্রতিনিধিদের দ্বারা ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক দলের অন্ধ আনুগত্য করা ছাড়া বিকল্প আছে কি? এমতাবস্থায় সরকার জনস্বার্থে স্থানীয় সরকার সিটি করপোরেশন আইন ২০০৯-এর ১৩(গ) ধারায় মেয়রের পদ শূন্য করতে পারে। তেমনি কাউন্সিলর-সহ স্ব-স্ব আইনে জেলাপরিষদ, পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেয়রের পদ জনস্বার্থে শূন্য ঘোষণা করার বিধান রয়েছে।  এতদসত্ত্বেও  অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন), অধ্যাদেশ ২০২৪, জেলাপরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৪ সহ কিছু সংশোধনী জারি করে শূন্যপদে প্রশাসক নিয়োগের আইনগত ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করেছেন। সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুসারে ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ পৌরসভা এবং   উপজেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এতে জনদুর্ভোগ লাগব হবে মর্মে জনগণের প্রত্যাশা।

স্বস্তির বিষয় এই যে, প্রশাসনে পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তাদের সদাসয় বর্তমান সরকার ভতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কিছু সিনিয়র কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে সচিবালয়ে পদায়ন করেছে, তা প্রশংসার দাবিদার । আরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পদোন্নতিবঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছ মর্মে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রদানপূর্বক যেসব কর্মকর্তাকে নিয়মিত পদে পদায়ন করা সম্ভব হবে না তাদের মধ্যে থেকে অভিজ্ঞ, যোগ্য এবং দক্ষ কর্মকর্তাকে পদমর্যাদা অনুসারে স্থানীয় সরকারসহ  বিভিন্ন সংস্থায় প্রশাসক বা চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সদস্য কিংবা পরিচালক ইত্যাদি পদে পদায়ন করা যেতে পারে। এতে পদোন্নতিবঞ্চিত  উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত  কর্মকর্তার বঞ্চনা উপশমের সুযোগ সৃষ্টি হলো।  

 

লেখক: যুগ্ম সচিব (অবসরপ্রাপ্ত), সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। লেখাটি গত ১৯ আগস্ট নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেন
 

আরবি/জেডআর

Link copied!