ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে জাতিসংঘের সতর্কতা ও বাংলাদেশের বন্যা

মো. সায়েম ফারুকী

প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৪, ১০:৩৪ পিএম

প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে জাতিসংঘের সতর্কতা ও বাংলাদেশের বন্যা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বন্যায় ডুবেছে বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ পার্বত্যাঞ্চল। বন্যার ফলে এত দ্রুত ও ভয়াবহ বিপর্যয় দেশের মানুষ আগে প্রত্যক্ষ করেনি। আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ১২ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। এসবের কোথাও বুকসমান পানি, কোথাও গলা পর্যন্ত পানি। ঘরে থাকার উপায় নেই। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় আগামী অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য ইউএনডিআরআরের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়েছেন ইউএনডিআরআরের এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান মার্কো তোসকানো-রিভালতা।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে বিপর্যয়ের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁঁকি হ্রাসবিষয়ক দপ্তর (ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন-ইউএনডিআরআর)। তিনি জানান, ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এমনই পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁঁকি হ্রাসবিষয়ক দপ্তর ইউএনডিআরআর। এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁঁকি হ্রাসকরণবিষয়ক এই সম্মেলনটি এশিয়া-প্যাসিফিক মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্স অন ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন বা এপিএমসিডিআরআর নামে পরিচিত। সম্মেলনটির লক্ষ্য দুর্যোগ ঝুঁকি এবং স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস করার জন্য টেকসই এবং বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য এই সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলের ৬২টি দেশের মোট ২ হাজার ৫০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে। 

ইউএনডিআরআরের এশিয়া-প্যাসিফিক আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান মার্কো তোসকানো-রিভালতা বলেন, ‘এই শক্তিশালী অনুমান ইঙ্গিত দেয় যে, ২০১৫ সালে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বিশ্বব্যাপী সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, তা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি।’ ‘সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ একটি বৈশ্বিক চুক্তি, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে দুর্যোগ পরিকল্পনা, মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে সহায়তার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। আঞ্চলিক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে রিভালতা বলেন, ‘মৌলিক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম দ্বিগুণ করতে হবে।’ 

বর্তমান সংবাদগুলোতে দুর্যোগের খবর খুব বেশি থাকে। আগের চেয়ে এখন আরও বেশি মানুষ একটার পর একটা দুর্যোগের শিকার হচ্ছেন। বেলজিয়ামের দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ অন দি এপিডেমিওলজি অব ডিজাস্টারস জানায়, কেবল ২০১০ সালেই ৩৭৩টা দুর্যোগ ঘটেছিল। ফলে অন্ততপক্ষে ২,৯৬,০০০ জন লোক মারা গিয়েছিল। এ ছাড়া দুর্যোগগুলো সম্বন্ধে যে-রিপোর্টগুলো করা হয়েছে, বিগত কয়েক দশক ধরে সেগুলোর সংখ্যাও লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৩০০টার মতো দুর্যোগের বিষয়ে রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু, ২০০০-১০ সালের মধ্যে বছরে গড়ে ৪০০-র কাছাকাছি দুর্যোগের বিষয়ে রেকর্ড করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে পাশের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসহ সংলগ্ন এলাকায় অতি বৃষ্টিকে। এই অতি বৃষ্টির কারণ হিসাবে ‘ক্লাউডবার্স্ট’কে চিহ্নিত করেছেন আবহাওয়াবিদরা। মৌসুমি বায়ু যখন বেশ সক্রিয়, তখন এই ক্লাউডবার্স্ট বা মেঘ বিস্ফোরণ ঘটে। এ কারণে ত্রিপুরা রাজ্যে গত সপ্তাহে প্রবল বর্ষণ হয়। সেই বৃষ্টির পানি ভাসিয়েছে রাজ্যটিকে। আর উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে ডুবেছে বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। বঙ্গোপসাগরে এই সময়ে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ১৬ আগস্ট উঠে আসে স্থলভাগে। এই সময় পশ্চিমা বায়ুও ঠান্ডা বাতাস নিয়ে আসছিল। বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, সুস্পষ্ট লঘুচাপটি প্রচুর মেঘ নিয়ে আসে স্থলভাগে, একই সময়ে পশ্চিমা বায়ু ঠান্ডা বাতাস নিয়ে আসে। সাগর থেকে আসা উষ্ণ মেঘ আর পশ্চিম দিক থেকে ঠান্ডা বায়ু মিশে প্রচুর মেঘ হতে থাকে। “ভূ-উপরিস্থ চাপের কারণে ওই মেঘ ফেনী, নোয়াখালী ও ভারতের ত্রিপুরার ওপর দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী থাকার পর ক্লাউডবার্স্ট ঘটেছে। ফলে অল্প সময়ে দু-তিন দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টি হয়।” এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ক্লাউডবার্স্ট বলতে বুঝিয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় অল্প সময়ের মধ্যে আকস্মিক অস্বাভাবিক অতি বৃষ্টিপাতকে। এতে বজ্রসহ বৃষ্টি কিংবা শিলাবৃষ্টিও হতে পারে। সাধারণত বজ্রপাতের সঙ্গেই ক্লাউডবার্স্টের যোগসূত্র বেশি। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর ক্লাউডবার্স্টকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবেÑ যখন ২০ থেকে ৩০ বর্গকিলোমিটার ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ঘণ্টায় ১০০ মিলি মিটার ছাড়িয়ে যায়, তখন তাকে ক্লাউডবার্স্টের কারণ ধরে নেওয়া যায়। সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় ক্লাউডবার্স্ট বেশি দেখা যায়। তবে সমভূমিতেও ক্লাউডবার্স্ট হয়। ঘনীভূত মেঘ যখন পাহাড়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন যেদিকে বাধা পায় পাহাড়ের সেই ঢালে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়, বিপরীত ঢালে প্রবাহিত বায়ু থাকে শুষ্ক। পাহাড়ি এলাকায় এই ক্লাউডবার্স্ট হঠাৎ পানি বাড়িয়ে ঢলের সৃষ্টি করে, তাতে নিচের অংশে দেখা দেয় বন্যা। ত্রিপুরা যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল, ঘনীভূত মেঘ সেখানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে ১৯ আগস্ট থেকে পরের কয়েকদিন। তাতে সেখানেসহ সংলগ্ন বাংলাদেশেও নদীতে হঠাৎ পানি বেড়ে দেখা দিয়েছে বন্যা। 

পৃথিবীর একদিক ভেসে যাচ্ছে পানিতে, অন্যদিক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরই ইউরোপ, নাইজেরিয়া, উগান্ডা আর ভারত ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। অন্যদিকে, কানাডা, মাদাগাস্কার, সাইবেরিয়া পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন আর এর ভয়াবহতা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে সতর্ক করে আসলেও মানুষের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পরিবেশ রক্ষার পরিবর্তে উল্টো পরিবেশ দূষণ নিয়ে ব্যস্ত মানুষ।

গাফিলতির ফলে, চলতি বছর রেকর্ড ছাড়িয়েছে উত্তর আমেরিকার তাপমাত্রা। দাবানলে পুড়ছে বন। মাটি হয়ে যাচ্ছে কৃষিকাজের অনুপযোগী। স্মরণকালের ভয়াবহ বৃষ্টি ও বন্যায় ভাসছে বাংলাদেশ সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশ। কিছুদিন ধরেই তাই পশ্চিমা বিশ্বে শিরোনাম এই জলবায়ু পরিবর্তন। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড মেটেওরোলজিক্যাল সংস্থা বলছে, এসব দেশের বিপর্যয়গুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ছাড়া অন্য কিছুই না।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই দশকের শেষের দিকে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এখনকার সময়ের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে তখন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা। প্রকৃতিকে সমতা নেই, যেটার একমাত্র কারণ মানুষ। তাই আমাদের এখনই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার।

 

সম্পাদক, রূপালী বাংলাদেশ

আরবি/জেডআর

Link copied!