“তাই তোমার জন্মদিনের নাম দিয়েছি আমরা বড়দিন,
স্মরণে যার হয় বড় প্রাণ, হয় মহীয়ান চিত্ত স্বার্থহীন ।
আমরা তোমায় ভালোবাসি, ভক্তি করি...,
তোমার সঙ্গে যোগ যে আছে এই এশিয়ার, আছে নাড়ির টান ।”
(সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বড়দিন)
আজ ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মহা-আনন্দের দিন। আজ যিশু খ্রিষ্টের জন্মদিন, পৃথিবীর নানা জায়গায় যুদ্ধের সংকটের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীর মাঝে এসেছে মানবপ্রেমের দিশারি মহামানবের আবির্ভাব তিথি। কিন্তু কয়েকটি দেশের যুদ্ধ-হামলা পাল্টা হামলা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেই সংকট মানুষকে মানুষে মানুষে একত্রিত হতে নিষেধ করলেও খ্রিষ্টের বাণী আজ জয়যুক্ত হচ্ছে সর্বত্র। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন নাভিশ্বাসে চড়লেও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মানুষ বিপন্ন হলেই তাদের খোঁজ নিচ্ছে, সহায়তা দিতে সাহসী ভূমিকা রাখছে- পরোপকারী একদল মানুষ দিনরাত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা দিয়ে নির্ভীকভাবে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফ্রন্টলাইনের সেসব মানুষ- তথা ডাক্তার-নার্স এবং অন্য যোদ্ধারা প্রকৃতপক্ষে মহামানবের দেখানো পথে হাঁটছেন।
প্রভু যিশু খ্রিষ্ট ঠিক ২০২৩ বছর আগে ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে কুষ্ঠরোগীকে স্পর্শ করেছিলেন; অন্ধ এবং মৃত মানুষকে সুস্থ ও জীবন দান করে মানবসেবার মহিমা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। দেশ-বিদেশে মানুষের জন্য অপর মানুষের যে কান্না শোনা যাচ্ছে, দানের ইতিহাস রচিত হচ্ছে, তা পবিত্র আলোয় স্নাত করে দিয়েছে সভ্যতাকে। আর সেখানেই আছে মানবপ্রেমের নেতা যিশুর বাণী। যিশু পাপের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঘৃণা নয়, ভালোবাসো। ভালোবাসো সবাইকে, ভালোবাসো তোমার প্রতিবেশীকে, এমনকি তোমার শত্রুকেও। মানুষকে ক্ষমা কর, তাহলে তুমিও ক্ষমা পাবে। কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে তার দিকে অপর গালটিও পেতে দাও।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর। গরিব-দুঃখীদের সাধ্যমতো সাহায্য কর, ঈশ্বরকে ভয় কর।’
সারা বিশ্বে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বড়দিন উৎসব উদযাপনের রূপটিও ভিন্ন হয়ে থাকে। উপহার প্রদান, সংগীত, খ্রিষ্টমাস কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ এবং খ্রিষ্টমাস ট্রি, আলোকসজ্জা, যিশুর জন্মদৃশ্য অঙ্কন এবং ‘হলি’ সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের অঙ্গ।
চলতি বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বড়দিনের উৎসব কিছুটা ভিন্ন। ২০২৩ সালের এই দিনটি উপলক্ষে আমরা গির্জায় গির্জায় প্রাক-বড়দিন উৎসব করলাম। তার আগে খ্রিষ্টান সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আর্চবিশপ থেকে শুরু করে অন্য চার্চের বিশপদের সান্নিধ্যে কেক কেটে আগত সময়কে প্রাণে ধারণ করে উৎসাহে উদ্দীপনায় সম্প্রীতির কথা ছড়ালেন। গতবার আমরা প্রাক-বড়দিনের অনেকগুলো অনুষ্ঠান সুন্দর করে উদযাপন করেছি। বড়দিনের দিনটি আন্দনঘন হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়। আসলে শান্তি ও কল্যাণের বাণী নিয়ে প্রভু যিশুর এই আগমনী দিনটিকে উদযাপন করতে নানা আয়োজন করা হয়। সারা বিশ্বের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের মতো বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও দিনটি পালন করে আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে।
বড়দিনের বেশ কিছুদিন আগ থেকেই শুরু হয়ে যায় যিশুকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি। প্রস্তুতি দুই ধরনের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক। আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি হলো- ঈশ্বরের কাছে পাপের ক্ষমা চেয়ে পাপের জন্য অনুতাপ করা এবং কারও সঙ্গে বিরোধ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করা। আর বাহ্যিক প্রস্তুতি মানে তো আলোকসজ্জা ও সাজ সাজ রব। সকাল থেকেই গির্জায় সমবেত হন ভক্তরা। যিশুর আশীর্বাদ ও বিশ্বের কল্যাণের জন্য প্রার্থনায় অংশ নেন তারা। বড়দিনের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানানো, কেক বানানো আর নতুন জামাকাপড় বানানোর ধুম। এ ছাড়া আছে বড়দিনের কীর্তনের রিহার্সেল, নাটকের রিহার্সেল আর বড়দিনের বিশেষ ম্যাগাজিন ছাপার কাজ। বড়দিনের আগের রাতে এবং বড়দিনের সকালে গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান (খ্রিষ্টযোগ) হয়। এদিন সব বাড়িতেই থাকে কেক, পিঠা, কমলালেবু, পোলাও-বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ও উন্নতমানের খাবার-দাবারের আয়োজন।
২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে গির্জায়-গির্জায় বেড়ানো, অতিথি আপ্যায়ন আর আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়েই কেটে যায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে আনন্দের দিন, বড়দিন। সবাই একে অপরের সঙ্গে বড়দিনের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের আয়োজন নিয়ে চলে মিডিয়ার সম্প্রচার। রাজধানীর বিভিন্ন গির্জার প্রার্থনা, আর রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোর বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা সত্যিই নান্দনিক হয়ে ওঠে। তবে হোটেলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে শিশু-কিশোর। সেখানে সান্তাক্লজ ও ক্রিসমাস ট্রি আলোকমালায় বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। ২০২৪ সালের বড়দিনের এসব আয়োজন আলো ছড়াবে, যিশুর জন্মদিন বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে মানুষকে আলোড়িত করবে। কারণ খ্রিষ্টের জন্ম ও জীবন আলোর সঙ্গে জড়িত। বড়দিন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বড়োদিন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আজ তার জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কালগণনায়? সেদিন সত্যের নাম ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেইদিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেইদিনই বড়দিন- যে তারিখেই আসুক। ...সেদিন বড়দিন নিজেকে পরীক্ষা করার দিন, নিজেকে নম্র করার দিন।’
দুর্যোগ ও সংকট মোকাবিলা করে আমরা স্মরণ করছি যিশু খ্রিষ্টের জীবনকে। জেরুজালেমের বেথলেহেম শহরের এক গোয়ালঘরে জন্ম হয়েছিল একটি শিশুর। শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল ‘ইম্মানুয়েল’ অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে ঈশ্বর। আমাদের ত্রাণকর্তা এই শিশুটি কিন্তু মোটেও সাধারণ শিশু ছিলেন না। শিশুটির জন্ম হয়েছিল ঈশ্বরের প্রভাবে মারিয়ার গর্ভে। মারিয়ার স্বামী কাঠমিস্ত্রি যোসেফ ছিলেন যিশুর পালক পিতা মাত্র। এই শিশুটি আসলে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র। পৃথিবী যখন পাপে পরিপূর্ণ, ঈশ্বর তখন তার একমাত্র পুত্রকে মানুষরূপে পৃথিবীতে পাঠালেন মানব জাতিকে পাপের পথ থেকে উদ্ধার করতে, শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করতে। রাতের বেলা বেথলেহেমের মাঠে ভেড়া চড়াচ্ছিল একদল রাখাল। যিশুর জন্মের পরপরই স্বর্গদূতেরা এসে তাদের বললেন, ওই গোয়ালঘরে তোমাদের উদ্ধারকর্তা জন্মেছেন, যাও তাকে শ্রদ্ধা জানাও এবং ঈশ্বরের প্রশংসা কর। রাখালেরা তা-ই করলেন। যিশুর জন্মের পরপরই আকাশের বুকে ফুটে উঠেছিল একটি বিশেষ তারা। পূর্বদেশের পণ্ডিতেরা সেই তারা দেখে বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে সেই মহান রাজার জন্ম হয়েছে, ঈশ্বর যাকে পাঠানোর কথা বলেছিলেন মানবজাতির মুক্তির জন্য।
পূর্বদেশের তিন পণ্ডিত বহু দূরদেশ থেকে বেথলেহেমে রওনা হলেন, তাদের রাজাধিরাজকে শ্রদ্ধা জানাতে। রবীন্দ্রনাথের খ্রিষ্টকে নিয়ে লেখা ‘শিশুতীর্থ’ কবিতায় এই যাত্রাপথের অনন্য চিত্রের শেষাংশটি এ রকম- ‘প্রভাতের একটি রবিরশ্মি রুদ্ধদ্বারের নিম্নপ্রান্তে তির্যক্ হয়ে পড়েছে।/সম্মিলিত জনসংঘ আপন নাড়িতে নাড়িতে যেন শুনতে পেলে/সৃষ্টির সেই প্রথম পরমবাণী- মাতা, দ্বার খোল।/দ্বার খুলে গেল।/মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তার শিশু,/উষার কোলে যেন শুকতারা।/দ্বারপ্রান্তে প্রতীক্ষাপরায়ণ সূর্যরশ্মি শিশুর মাথায় এসে পড়ল।/কবি দিলে আপন বীণার তারে ঝংকার, গান উঠল আকাশে/জয় হোক মানুষের, ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।/সকলে জানু পেতে বসল, রাজা এবং ভিক্ষু, সাধু এবং পাপী, জ্ঞানী এবং মূঢ়;/উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করলে- জয় হোক মানুষের,/ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।’
‘চিরজীবিতের’ যিশু নামের সেই শিশুটি বড় হয়ে উঠলেন মানুষের মনের রাজা হয়ে। পাপ থেকে মুক্তির আলো হয়ে। স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মুসলমানরাও তাকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশ্ববাসী এই সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট, যদিও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ধর্মীয় উগ্রবাদকে উস্কে দিচ্ছে। তবে খ্রিষ্টানসহ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার যাতে ভোগ করতে পারে বর্তমান সরকার এবং আগামীর রাষ্ট্রপ্রধান সে ব্যবস্থাই করবেন- এটাই এবারের বড়দিনে সবার প্রত্যাশা।
আপনার মতামত লিখুন :