একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সেই গল্প আমরা অনেকদিন ধরে শুনছিলাম। অপেক্ষায় ছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাওয়ার। কিন্তু সব ঠিক হলো না। পেঁয়াজের দাম বাড়ল, আমাদের ওপর নির্দেশ এলো পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্না করার। গরুর মাংসের দাম বাড়ল, আমাদের ওপর নির্দেশ এলো গরুর মাংসের বদলে কাঁঠালের তরকারি রান্না করার। বর্ধিত দামের খাবারগুলোর বিকল্প বাতলে দিতেন ‘তিনি’। কেবল তার কোনো বিকল্প ছিল না বলে প্রচার করা হতো। তিনি সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার নামের আগে যুক্ত হয়েছে স্বৈরশাসক শব্দটি।
শেখ হাসিনার পতনের পর গণভবনের রেফ্রিজারেটর থেকে কী কী বেরিয়ে এসেছিল, তা দেশবাসী দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গত ৫ আগস্ট বোনকে নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর গণভবনে ঢুকে পড়ে গণমানুষ। সেখান থেকে তারা বের করে আনে অতিকায় আকৃতির ইলিশ, বোয়াল, গরুর রান, জীবন্ত হাস-মুরগি। জনগণের করের টাকায় কেনা বুলেটে যখন তরুণদের রক্ত ঝরছিল, সেই দুপুরের জন্য ওই রাজপ্রাসাদে প্রায় ৮-১০ পদের খাবার রান্না হয়েছিল, সেটিও মানুষ দেখেছে। অথচ এদেশের ন্যূনতম কর দেওয়া জনগণও ১ পদের তারকারি দিয়ে ভাত জোটাতে হিমশিম খাচ্ছিল। গণভবনের ডেইরি ফার্ম থেকে রোজ ৫৬ লিটার দুধ বিনামূল্যে বিরতণ করা হতো। সেই তালিকা থেকে জানা গেছে, গণভবনের ক্লিনাররাও দিনে ৫০০ গ্রাম থেকে ১ লিটার দুধ পান করার জন্য বিনামূল্যে পেতেন। আর জনগণ শুধু চেয়েছিল ন্যায্য দামে বাজার থেকে কিনতে। পারেনি। সামান্য চাল-ডাল কিনতে তাদের নাভিশ্বাস উঠে গেছে, যা রূপান্তরিত হয়েছে দীর্ঘশ্বাসে। সেই দীর্ঘশ্বাসের ঝড়ে ধুলায় মিশেছে গণভবন নামের প্রাসাদ।
সরকার ন্যায্যমূল্যে ট্রাকে করে যে পণ্য বিক্রি করে, সে এক নির্মম পরিহাস যেন। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক ন্যায্যমূল্যে তার নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনার অধিকার রাখেন। সেটা কেন তাকে খোলা রাস্তায় একটি ট্রাকের পেছনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কিনতে হবে? ভাবতে অবাক লাগে, রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে সে কি আর একটু সম্মানজনক উপায়ে তার প্রয়োজনের চাল-ডাল কেনার অধিকার রাখে না? রাষ্ট্র কি তার জনগণের ওপর নির্ভরশীল, নাকি জনগণ তার দেশের সরকারের ওপর নির্ভরশীল? সরকার কেন বারবার ভুলে যায় যে, সে জনগণের সেবক, দেশের ব্যবস্থাপক মাত্র? নাকি জনগণের জানমাল ও মান-সম্মানের মালিক উপরের ওই আসনধারীরা? তারাই দয়া করে একটু অল্প দামে খাবার দিচ্ছেন প্রজাদের!
ট্রাকের বাইরের বাজার যেন ইউরোপের বাজার! গত অক্টোবরের ১৪ তারিখ ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি বন্ধুর কাছে জানতে চাই তার ওখানে ডিমের দাম কত? তিনি জানান, ৩০টি ডিম তিনি বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে ৪শ টাকায় কিনেছেন সেদিন। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, একই দিনে ঢাকায় আমরা ৪শ ৩০ টাকায় ৩০টি ডিম কিনছি, তিনি বিস্মিত হলেন। বাংলাদেশ উন্নত হয়ে সিঙ্গাপুর বা ইউরোপ হয়ে গেছে বলে যে প্রচার চালাতেন পতিত আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সুবিধাভোগী সমর্থকরা, তারা ভুল বলতেন না। অনেক দেরিতে হলেও সেটা উপলব্ধি করেছি আমরা। কিন্তু এই ইউরোপে বেঁচে থাকা তাদের জন্য সহজ, যারা অবৈধ উপায়ে, পা চেটে, সম্মান বিসর্জন দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। ‘ক্রয়ক্ষমতা’ শব্দটি তাদের কাছে আলাদা কোনো অর্থ বহন করে না। অথচ দেশের অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হারানোর পেছনে তাদের যে হাত ছিল তা সবারই জানা।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একটি দৈনিকে ‘কৃষক থেকে ঢাকার ভোক্তা, দাম বাড়ে ৬-৭ গুণ’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, শিম উৎপাদনে কৃষকের কেজিপ্রতি খরচ হয় ৬ টাকা ৮৮ পয়সা, যা তারা বিক্রি করেন ২৫ টাকায়। আর ঢাকায় কেজি প্রতি ওই শিম বিক্রি হয় ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। কৃষকের ওই শিম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে ঢাকায় এলেও এই টাকা খরচ হওয়ার কথা না। কিন্তু কীভাবে হচ্ছে সেটা? ওই প্রতিবেদন বলছে ১৩ টাকা ২০ পয়সা উৎপাদন ব্যয়ে ১০-১৫ টাকায় বিক্রি করা লাউ ভোক্তাদের কিনতে হয় ১০০ থেকে ১৩০ টাকায়। কৃষকের হাত থেকে ভোক্তার হাতে আসার মাঝে কারা এই দাম বাড়াচ্ছে? চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি ‘সবজির দাম বাড়ার নেপথ্যে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের অনেকগুলো কারণের একটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা বা করতে না চাওয়া। ভোট না দিয়ে মানুষ হয়তো বাঁচতে পারে, কিন্তু পেটে ভাত না দিয়ে তো বাঁচা যায় না। তার ওপর কোনো এক ভোটের আগে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানোর ‘ব্র্যান্ডিং’ আওয়ামী লীগের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকারের মতো নানা রকম অধিকারবঞ্চিত মানুষ এক হয়ে ব্যর্থ সরকারকে হটিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক, অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও বটে। মানুষ চায় জাদুবলে সরকার সব ক্ষত মুছে ফেলুক, মানুষকে দুদণ্ড শান্তি দিক, দুটো ভাত খেয়ে শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ দিক। অথচ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি বাংলাদেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে এবং কোটি কোটি মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছে। পরাজিত শক্তি এখনো সক্রিয় অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টায়। সেসব প্রতিহত করে দেশকে সঠিক পথে আনার আগে মানুষের পাতে ভাত দিতে হবে সরকারকে। মানুষ যাতে ন্যায্যমূল্যে বাজার থেকে নিত্যপণ্য কিনতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কুচক্রীদের যে সিন্ডিকেটের কথা বারবার উঠে আসছে, সেটা ভাঙতে হবে। যারা এত শক্তিশালী একটা স্বৈরশাসকের ক্ষমতার দুর্গ ভেঙে দিতে পেরেছে, তাদের কাছে বাজারব্যবস্থার সিন্ডিকেট কি একটা ডিমের খোসার চেয়ে শক্ত হতে পারে?
সিন্ডিকেট ভাঙার সমাধান মানুষই দিতে শুরু করেছে। একটি ডিজিটাল বোর্ডের কথা শোনা যাচ্ছে, যা বাজার ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখতে পারে। সেখানে মানভেদে বিভিন্ন পণ্যমূল্য ও গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া থাকবে। বাজারের কারসাজি বন্ধে এমন কেন্দ্রীয় ডিজিটাল মূল্য তালিকা স্বচ্ছতা নিশ্চিতের হাতিয়ার হতে পারে বলে মনে করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ওই ডিজিটাল বোর্ডে লেখা থাকবে পণ্যের খুচরা ও যৌক্তিক মূল্য। দেখা যাবে, কত দামে পণ্যটি কোন অঞ্চল থেকে বাজারে এলো। এ ছাড়া আরও নানা উপায়ে এই দুষ্টু বাজারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে এটা হচ্ছে পুরো ব্যবস্থার একেবারে সর্বশেষ কাজ। এর আগের কাজগুলো ঠিকঠাক মতো করতে পারলে ডিজিটাল বোর্ড হবে শেষ ধাপের কাজ। এর আগের কাজ হচ্ছে উৎপাদন, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন চক্রের ভূত তাড়ানো।
সরকারকে নজর দিতে হবে, কৃষকের হাতে বীজ ও সার ন্যায্য দামে পৌঁছাচ্ছে কি-না সেদিকে। জানতে হবে, উৎপাদনের উপকরণগুলো কি তাদের কাছে সহজলভ্য? উৎপাদিত পণ্য কি তারা যথাযথ ও ন্যায্যদামে বিক্রি করতে পারছেন? এ প্রসঙ্গে ১৯৯০-এর ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের আগে ইরাকি এক ব্যবস্থার গল্প ভাগাভাগি করা যাক। ইরাক প্রবাসী এক বাংলাদেশি সেখানকার অভিজ্ঞতা জানিয়ে আমাকে বলেছিলেন, দেশটির সরকার এক শ’ টাকায় ওষুধ কিনে জনগণকে ৫০ টাকায় খাওয়ায়। দেশটির পণ্যব্যবস্থাপনার আরেকটি ঘটনা তিনি জানাচ্ছেন এভাবে- গরুর খামারির দুয়ারে তার গরুকে খাওয়ানোর ঘাস রেখে যেত সরকারি গাড়ি। ওই একই জায়গায় গরুর দুধ রেখে দিতেন খামার মালিক। সরকারি গাড়ি সেই দুধ নিয়ে গিয়ে সরবরাহ কেন্দ্রে জমা দিত। ঘাসের নামমাত্র দাম বাদ দিয়ে দুধের দাম খামার মালিকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যেত। ওই দুধ সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিনতে পারতেন দেশের সাধারণ মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে আজ চমৎকার এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা আমাদের জন্য কঠিন কিছু নয়। চাষিদের কাছ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্য দামে কৃষিপণ্য কিনে যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। সেখান থেকে ওসব পণ্য যেতে পারে স্থানীয় ও দূরের বাজারে। পণ্যটি কত টাকায় উৎপাদিত হলো, কত টাকায় কৃষকের কাছ থেকে কেনা হলো, পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় যুক্ত করে চূড়ান্ত ভোক্তার কাছে কত টাকায় বিক্রি হবে, প্রতিটি পর্যায়ের দামের তথ্য যদি অ্যাপসে যুক্ত করা হয়, তাহলে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে আর দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না। থাকবে না মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। অনেক হাত ঘুরে ভোক্তার হাতে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা এভাবে বন্ধ করতে হবে। এ কাজে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সক্রিয় করতে হবে। সদিচ্ছা, সততা ও যথাযথভাবে নিজের কাজটা সবাই করছে কি-না, সেটা মনিটরিং করতে পারলে এই ব্যবস্থা দাঁড় করানো কঠিন নয়।
খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরও এক কারণ জ্বালানি তেলের দাম। কৃষকের জন্য ডিজেল ও পণ্য পরিবহনে পেট্রোলের দাম কেন বারবার বাড়ছে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার পরও কেন বাংলাদেশে কমছে না সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। জ্বালানি তেলের বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙাও এ ক্ষেত্রে জরুরি। জ্বালানি তেল পরিশোধনে এস আলম গ্রুপের মতো গ্রুপকে হটাতেও সরকারের উচিত ছাত্রজনতার সহায়তা নেওয়া। আর ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই সেনাবাহিনী ও পুলিশকে সক্রিয় করতে হবে।
খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির (ওএমএস) যে পদ্ধতি, সেখানেও পরিবর্তন আনা জরুরি। কেননা অর্থের অভাবে যাদের নিত্যপণ্য কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তাদের কিন্তু সময়েরও অভাব রয়েছে। যেটুকু সময় তাদের হাতে রয়েছে, তা অর্থ উপার্জনে ব্যয় করার বদলে ওএমএসের লাইনে ব্যয় করাটা যৌক্তিক কথা নয়। তা ছাড়া ওই লাইনে স্থানীয় রেস্তোরাঁর লোকদের দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহের কথাও শোনা গেছে। ওএমএস থেকে পণ্য কিনে তা রেস্তোরাঁর জন্য রান্না করে বিক্রি করলে প্রকৃত অভাবী মানুষ বঞ্চিত হবেন। তাই ওএমএস-এ পণ্য বিক্রিও অ্যাপের আওতায় আনার আহ্বান জানাই। দরিদ্র মানুষের ডেটাবেজ যদি সরকারের কাছে থাকে, তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য সরকারের প্রতিনিধিরা তাদের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিতে পারেন। যারা কর দেন, তাদের তালিকা ও অর্থসম্পদের বিস্তারিত তথ্য যেমন সরকারের কাছে আছে, তেমনি অভাবী মানুষের তালিকাও সরকারের কাছে থাকা দরকার। এতে হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ব্যক্তিরা সাইফুল আলম গংদের গৃহপরিচারিকা নাকি গাড়িচালক সেসবও সরকারের নজরে থাকবে। পাশাপাশি পেশাদার চাষির তালিকাও সরকারের কাছে থাকা জরুরি। বোধকরি সেটি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধজয়ী দেশের মানুষকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা কৃষকদের সম্মান এমন হওয়া উচিত যে, তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।
শুধু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেই হবে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রতিটি উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ, দুষ্টের দমন অতিদুষ্টুমি নির্মূল করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ২০২৪-এর বিপ্লবকে সুসংহত করতে হলে মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিপ্লবীদের উদ্দেশে বলতে চাই- আমরা হাসিমুখে ভোটকেন্দ্র ও বাজার থেকে ফিরতে চাই।
আপনার মতামত লিখুন :