দেশে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। রাজধানী ঢাকার বস্তিগুলোয় প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া পোশাক কারখানা এবং পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের বীভৎস রূপ দেখেছে দেশবাসী।
অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধে জনসচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। নিমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারের পর সব রেকর্ড ভেঙে খাতায় নতুন নাম জায়গা করে নিয়েছিল বেইলি রোড। রাজধানীতে গত ১৪ বছরে ঘটে যাওয়া এ চার ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২৬৭ জনের।
এ ছাড়া, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ গত কয়েক বছরে ঢাকায় বেশ কটি বড় অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবার আগুন লাগার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। আশ্বাস দেওয়া হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। কিন্তু বাস্তবতার খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।
ঢাকা শহরের আগুন লাগার ঘটনা প্রায়ই আমাদের সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নেয়। এই অগ্নিকাণ্ডগুলো শুধু সম্পত্তির ক্ষতিই নয়, অনেক সময় মানুষের জীবনও হরণ করে। কিন্তু কেন ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা এত ঘন ঘন ঘটে? এ প্রশ্নের উত্তর মিললেও সমাধানের পথে হেঁটে হাঁপিয়ে যায় কর্তাব্যক্তিরা।
চলতি মাসের ১৭ তারিখে রাজধানীর হাজারীবাগের একটি ট্যানারি গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
সাততলা ওই ভবনের পঞ্চমতলায় এ আগুন লাগে। সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানের চামড়ার গুদাম ছিল। তবে আগুনের সূত্রপাত কীভাবে জানাতে পারেনি তারা। তবে শর্টসার্কিট কিংবা সিগারেটের কারণে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা করেছে সংশ্লিষ্টরা।
পুরান ঢাকার নিমতলীর স্মৃতিস্তম্ভটি এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই ১৪ বছর আগের ঘটনা। ২০১০ সালের ৩ জুন ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। ভয়াবহ সেই আগুনে আশপাশের বাড়ি ও ভবনগুলো পুড়েছিল।
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ছয় বছর পার হয়ে গেল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আশপাশে আগুন ছড়িয়ে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। ছয় বছর আগের ক্ষত এখনো অনেকের মনে অক্ষত। তবে ওই দিন বেঁচে যাওয়া ও স্বজন হারানো ব্যক্তিরা পোড়া স্মৃতি নিয়ে এখনো কাঁদেন।
ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা কমাতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, এবং জনগণ সবাইকেই এ বিষয়ে সচেতন হয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়।কোনো ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
তার হচ্ছে সক্রিয় ব্যবস্থা, এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অগ্নিনিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করবে। আর সক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আগুন ধরে গেলে সেটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত ভবনগুলোয় এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কারণে সেখানে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা কমে আসবে এবং আগুন লাগলেও তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকবে। একই কারণে এসব ভবনে আগুন লাগলে প্রাণহানি কম হবে বলে ধারণা করা হয়।
একটি ভবন নির্মাণের সময় কী ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে- তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্প এবং আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা ঠেকাতে এ ধরনের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে দরজা এবং দেয়াল আগুন-প্রতিরোধী হলে ভালো হয়।
এ ছাড়া ঘরের সিলিং, রান্নাঘরের আসবাবপত্র আগুন-প্রতিরোধী পদার্থে নির্মাণ এবং আগুন-প্রতিরোধী তার ব্যবহার করলে আগুন লাগলেও সেটি ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না। সিনথেটিক বা হাইড্রোকার্বন উপাদান থাকে এমন কোনো পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরের সজ্জা না করাই ভালো।
এগুলো হলো- আগুনের কাছে পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানির মতো মুখরোচক খাবার। এসব উপাদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যদিকে তেমনি আগুন লাগলে এসব উপাদান পুড়ে বিষাক্ত ধোঁয়া তৈরি হয়, যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ফলে আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে।
আবার এসব ধোঁয়ার কারণেই অনেক সময় মানুষ মারা যায়। প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি কোনো ভবনে আগুন লাগে তাহলে সে ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিকমতো কাজ করে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোনো এক জায়গায় আগুন লাগলে পুরো ভবনের বাসিন্দারাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা ভবন খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। ফলে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব।
যেকোনো ভবনেই আগুন লাগলে, সেটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে। এটা হতে হবে এমন একটি পথ যেখানে আগুন এবং ধোঁয়া প্রবেশ করতে পারবে না।
কারণ, কোনো ভবনে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে ওই ভবনের লিফট ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিটি ভবনেই অগ্নিনির্বাপণ সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে ভবনের বাসিন্দাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো একটি ভবনে আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে সেটি নিভিয়ে ফেলা যায় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়।
এ সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ব্যবস্থা নিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আশা করি, আমরা একযোগে কাজ করে ঢাকাকে আরও নিরাপদ শহরে পরিণত করতে পারব।
লেখক: প্রকৌশলী, কলাম লেখক
আপনার মতামত লিখুন :