দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন কমছে না, বরং বাড়ছে। উপার্জন করা সত্ত্বেও অর্থের ওপর নারীর অধিকার জন্মাচ্ছে না। যে উন্নয়ন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অবস্থানের কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না, তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদের জন্য কী ফল বয়ে আনছে?
অতি সম্প্রতি স্ত্রীকে মারধর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুরুষদের রেকর্ড অর্জন করার খবরটিকে আমরা উন্নয়নের কোন ক্যাটাগরিতে ফেলব? এটা কি পুরুষের আধিপত্যবাদী আচরণের নগ্ন প্রকাশ? নাকি সার্বিক মূল্যবোধের আরও অবক্ষয়?
একদিকে উন্নয়নের তুলনা চলছে বিশে^র উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে, অপরদিকে নারী নির্যাতনে প্রতিযোগিতা করছি পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর সঙ্গে। যেসব উন্নত দেশের সমান হওয়ার স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেরকম ৩০টি দেশে করোনা মহামারির মধ্যে সবচেয়ে কম অর্থাৎ ৪ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
বিশে^র যেসব দেশে স্বামী বা সঙ্গীর হাতে নারী নির্যাতনের হার বেশি, সেসব দেশের তালিকায় ৪র্থ স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। দেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই জীবনে কখনো না কখনো সঙ্গীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি দেখে একটুও বিস্মিত হইনি। কারণ সমাজের চারদিকে চোখ মেললেই দেখতে পাই নারীকে এদেশে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। ঘরের বউকে মনে করা হয় নিজের সম্পত্তি। আর নিজের সম্পত্তি ইচ্ছামতো ব্যবহারের স্বাধীনতা তো রয়েছেই! তাই বউ বা সঙ্গীকে মারতে মারতে বিশ্বে রেকর্ড করে ফেললেও, বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরুষ মনে করে তারা কোনো অন্যায় করেনি এবং তারা এজন্য লজ্জিতও নয়।
আমাদের দেশের শহর ও গ্রামের শতকরা ৬৩ ভাগ পুরুষ এখনো মনে করে, ‘সহবাসে রাজি না হলে বউকে মারাটা জায়েজ।’ আর অপরদিকে শতকরা ৬২ জন পুরুষ বিশ্বাস করে যে, ‘এমনও সময় আসে, যখন বউয়ের নিজের কাজের জন্যই তার মার খাওয়াটা উচিত হয়ে যায়।’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের করা এক জরিপে সম্প্রতি এই ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন পুরুষ স্ত্রীকে মারধর করে? আমরা দেখেছি এই ‘কেন’র কোনো উত্তর নেই। ভাত দিতে দেরি হলে, হাতের কাছে জিনিস খুঁজে না পেলে, পরপর দুটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে, সারাদিন রান্নার পর শরীরে তেল-মসলার গন্ধ পেলে, খেটে খাওয়া নারী সময়মতো মজুরি না পেলে, ‘প্রভু’ স্বামী ঘুমানোর সময় বাচ্চা কাঁদলে, স্বামীর চাহিদা মতো সহবাসে রাজি না হলে, স্বামীর অন্যত্র প্রেম থাকলে, ঘর-দুয়ার ময়লা থাকলে, কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরতে দেরি হলে, নিজের অর্জিত টাকা স্বামীর হাতে পুরোটা তুলে না দিলে, এমনকি পর্নোগ্রাফির নায়িকাদের মতো বিছানায় পারফর্ম করতে না পারলে এবং এ রকম আরও অনেক তুচ্ছ কারণে স্ত্রীকে মার খেতে হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ কারণটা হলো- যৌতুকের জন্য বউকে পেটানো এবং হত্যা করা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী (পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্য) ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে শুধু যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১২ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮ জন। এই ঘটনার বাইরে আরও ২৯ জন নারী স্বামীর হতে নিহত হয়েছেন। মারধরের ঘটনা ঘটেছে ৬৪টি, মামলা হয়েছে ২১টি। সাধারণত এই মারধরের সঙ্গে পরিবারের সবাই জড়িত থাকে।
স্বামীর কাছে মারধরের শিকার হয়ে সমাজের উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত দুজন এমজেএফ অফিসে এসে সাহায্য চেয়েছিলেন যে, তারা স্বামীর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিতে পারেন? নানা ধরনের আইনি পরামর্শ নেওয়ার পরও তারা কোনোটাই করেননি। বরং একজন বাচ্চা নিয়েছেন, যাতে স্বামী ঠিক হয়ে যায়। স্বামীতো ঠিক হয়-ইনি, বরং বাচ্চা নিয়ে তিনি গত ৫ বছর ধরে বাবার বাড়িতে পড়ে আছেন। অন্যজন এখনো স্বামীর হাতে চড়-থাপ্পর খেয়ে চলেছেন। সমাজ কী বলবে, এই ‘শরমবোধ’ থেকে তারা কোনো মামলা করেননি। শিক্ষিত নারীর এ রকম নিগ্রহের শত শত উদাহরণ আছে।
গ্রামের নিরক্ষর বা স্বল্পশিক্ষিত নারীর অবস্থা আরও করুণ। এদের অধিকাংশ মনে করেন স্বামী ভাত দেয়, তাই মারতে পারে। এ ছাড়া সহবাসে তুষ্ট না হলে, বাচ্চার দেখাশোনায় ত্রুটি হলে, স্বামীকে না বলে বাইরে গেলে এবং মুখে মুখে তর্ক করলে স্বামী পেটাতে পারে। এটা স্বামীর অধিকার। তারা অনেকেই বিশ^াস করে নারীর অবস্থান অধস্তন, কাজেই মার খাওয়াটাও জায়েজ।
গ্রামের সাধারণ নারী দরিদ্র, অসহায়, আশ্রয়হীন, অসচেতন কাজেই তাদের মুখ, হাত-পা বাঁধা। কিন্তু শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও তো মার খাচ্ছেন, শুধু পরিবার টিকিয়ে রাখা, সন্তানের লালনপালন ও লোকলজ্জার ভয়ে। প্রশ্ন উঠতেই পারে কোন পুরুষ তার স্ত্রী বা সঙ্গীকে মারে? যারা বউ পেটায়, তাদের কি আলাদা কোনো চেহারা আছে? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, না বউকে মারার জন্য ভিন্ন কোনো চেহারা লাগে না। যেকোনো সমাজের, যেকোনো অর্থনৈতিক অবস্থার পুরুষ এটা করে থাকে। শ্রমিক, কৃষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষক। যদিও স্ত্রী পেটানোর জন্য একটি কারণও গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু তাও বলা যায় গায়ের জোর, ক্ষমতা, অধিকারবোধ, আগ্রাসী মানসিকতা, মানসিক অসুস্থতা, হীনম্মন্যতা, ব্যর্থতা, অস্থিরতা, মাদকের ব্যবহার, আধিপত্যবাদী মন থেকে পুরুষ মারধর করে।
এরপরে আমরা ভাবি যে, স্বামী এতটা অত্যাচারী হওয়া সত্ত্বেও, কেন নারী তাকে ছেড়ে যায় না? কারও কারও সামনে আর কোনো উপায় থাকে না। আবার অর্থনৈতিক ও আবেগের কারণে নারীদের বুঝতেও সময় লেগে যায় যে অত্যাচারী স্বামীকে তার ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। যারা মারধর করে, সেই স্বামীও স্ত্রীকে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করে থাকে।
এ ছাড়া নারীর সহ্য করার মানসিকতা, তাকে আরও বেশি নাজুক করে তোলে এবং তার আত্মবিশ্বাসও একদম নষ্ট করে দেওয়া হয়। নারীকে সমাজ ভাবতে শেখায়, স্বামী ছাড়া সমাজে নারীর কোনো মূল্য নেই। তাকে নানা ধরনের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। নারী তখন আর আলাদা হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। আমাদের সমাজব্যবস্থা নারীর মনোজগতকে এমন করে কব্জা করে রেখেছে যে নারী নিপীড়িত হওয়াটাকে মনে না নিলেও, মেনে নিতে বাধ্য হয়। আর তাই দেশের চারজন বিবাহিত নারীর একজন ৫টি কারণে স্বামীর হাতে মার খাওয়াকে যৌক্তিক মনে করেন বলে আরেকটি সমীক্ষা জানিয়েছে।
বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে শিশু নিপীড়নের আরেকটি বড় হাতিয়ার। কারণ বাল্যবিয়ে যারা করে, সেসব পাপীদের বাল্যবিয়ে করার অন্যতম একটি কারণ শিশু স্ত্রীকে মারধর করে, ভয় দেখিয়ে বশে রাখা। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের ব্যাপকতা বিশ্বে চতুর্থ স্থানে। বাল্যবিয়ে যে শুধু নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাধা তা তো নয়, নারীর জীবন হুমকির মুখে চলে যায়। আমরা বারবার বলি বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েটির সঙ্গে সহবাস করা মানে, তাকে ধর্ষণ করা।
২০১৯ সালে দেশের এক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একটি জরিপে দেখেছে যে উত্তরদাতাদের প্রায় কেউই বিয়ে পরবর্তী ধর্ষণকে নারীর প্রতি সহিংসতা বলে মনে করে না। সমাজ মনে করে নারীর শরীরের ওপর তার স্ত্রীর অধিকার আছে। স্বামী যখন ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা তার স্ত্রীকে ভোগ করতে পারে। এজন্য চড়-থাপ্পর দেওয়াটাও জায়েজ।
গত মহামারি চলাকালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জরিপে দেখেছে যে, সারা দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর স্বামীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে না চাওয়া, স্ত্রীকে নির্যাতনের একটি বড় কারণ। এই অভিযোগ অনেক স্ত্রীই করেছেন, নানান ঝামেলা সত্ত্বেও স্বামী চাইত স্ত্রী তার সঙ্গে যৌনমিলন করুক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ২৭.৩ শতাংশ নারীই বলেছেন তারা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর জোরজবরদস্তির কারণেই যৌনমিলনে বাধ্য হন। অপরদিকে নির্যাতিত শিশু ও নারীর বাবা-মায়েরা বলেছেন, এ বিষয়ে তারা কোনো কথা শুনতে চান না। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সবই বৈধ, এমনকি মারধরও।
কিছু নারী শিক্ষায়, চাকরিতে, বিমান চালনায়, জাহাজ চালনায়, কৃষিতে, গবেষণায়, খেলায়, পর্বতারোহণে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা কি আমরা ঠেকাতে পারছি? এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে আমরা যতগুলোই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখাই না কেন, স্বামীর হাতে স্ত্রীর এই নির্যাতনের মাত্রা সব অর্জনকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়। এ শুধু নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের হিসাব, মানসিক নির্যাতনের মাত্রার চাইতে আরও বেশি।
আপনার মতামত লিখুন :