কিশোর-কিশোরী হলো ক্ষেত্রবিশেষে ১০ বছর থেকে ১৯ বছর বয়সের মাঝামাঝি বয়সি ছেলেমেয়ে। যদিও একেক আইনে, একেক বয়সিদের শিশু-কিশোর হিসেবে অভিহিত করে থাকে। আর গ্যাং অর্থ দল। নির্দিষ্ট কিছু লোকের একটা দলকে গ্যাং বলে। গ্যাং শব্দটি সাধারণত অপরাধ বা নেতিবাচক কাজে জড়িত কোনো দল বা গ্রæপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের প্রত্যেকটি দলকে ‘কিশোর গ্যাং’ বলে। এই মুহূর্তে দেশে অপরাধপ্রবণতা এত বেশি বেড়েছে, পত্রিকা, টেলিভিশন তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। আর মানুষ পথ চলতে আতঙ্কিত হয়। ভয়ে শিউরে ওঠে। সবিস্তারে আলোচনা করলে আরও পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে বোধ করি।
আমাদের বুঝতে হবে একজন কিশোর কখন গ্যাংয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়? সম-অপরাধপ্রবণ মানসিকতা একদল কিশোরকে একত্রিত করে পরবর্তী অপরাধ পরিক্রমায়। একটি অপরাধের বিচার না হলে আরেকটি অপরাধ করতেও পিছপা হয় না। এই অপরাধপ্রবণ কিশোরদের বাস্তবতার নিরিখে কিশোর গ্যাং হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রথমদিকে কিশোর গ্যাং কালচার রাজধানী ও বড় বড় বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে সারা দেশে ভয়াবহভাবে বাড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার। শহর, নগর ও গ্রাম সর্বত্রই সমান তালে গ্যাং কালচারের আধিপত্য। প্রতিটি জনপদেই তারা সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়ে এক মহা আতঙ্কের জাল বুনে দিচ্ছে, যা ক্রমেই দানবীয় আকৃতি ধারণ করতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যা মোটেই অমূলক নয়।
আর এই কিশোর গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশের বয়স ১৩-১৭ বছরের মধ্যে। ক্ষেত্রবিশেষে ১৯ বছর বা তার বেশি হলেও কিশোরদের সঙ্গে চলাফেরা করেও এই গ্যাংয়ের সদস্য হতে দেখা যায়।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০-১১-১৯৮৯ কনভেনশন অব দ্য রাইট অব দ্য চাইল্ড সম্মেলনে শিশুর বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়। সে আলোকে শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী একটি শিশুর বয়স ১৮ বছর নির্ধারিত হয়েছে। শিশু আইন-১৯৭৪-এ শিশুর বয়স নির্ধারিত ছিল ১৬ বছর। বাংলাদেশের পেনাল কোডের-৮২ ধারা মোতাবেক ৯ বছরের নিচে কোনো শিশুর আইনবহিভর্‚ত ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। ওই আইনে ৮৩ ধারা মোতাবেক বিচারকের দৃষ্টিতে ৯ বছরের নিচে ১২ বছরের বেশি না হলে কোনো শিশুর যদি ম্যাচিউরিটি শনাক্ত না হয়, সে ক্ষেত্রেও শিশুটি অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে না। ডিজিটাল যুগে ১৬-১৮ বছরের একজন কিশোর যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি লাভ করে। অথচ এরা যত বড় অপরাধই করুক না কেন তাদের শিশু আইনে বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। ওই আইনে হত্যাকান্ডের মতো গুরুতর অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর। ফলে তারা নানা অপরাধমূলক কাজ করেও আইনের সুবিধা ভোগ করার সুযোগ তাদের অনেককেই আরও বেশিমাত্রায় উৎসাহী করে তুলছে বলেও বিশ্লেষকদের ধারণা।
কিশোর গ্যাং রাতারাতি তৈরি হয় না। সমাজের নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে এরা সংগঠিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এদের দৌরাত্ম্য এত প্রকট আকার ধারণ করেছে, অনেকটা মহামারি বা অতিমারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর জন্য দায়ী কারা তা একবাক্যে বলা না গেলেও সামষ্টিকভাবে এ সমাজ বাস্তবতা কিংবা আমরা কেউই দায় অস্বীকার করার সুযোগ কি আছে? যদি থেকে থাকে তবে আমরা এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খুব সচেতন নই অথবা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছি! যখন নিজে আক্রান্ত হতে থাকব তখনই এর রেশ এবং জের সম্পর্কে ভাবতে শুরু করব। তার আগে নয়! সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সচেতন অভিভাবক সবাই দায়সারা গোছের বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে সেমিনারেই সীমাবদ্ধ করছি নিজেদের কার্যক্রম। নিশ্চয়ই আমাদের জানতে হবে এর ভয়াবহতা এবং বিস্তার। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই আমরা একটি বিকারগ্রস্ত যুবসমাজ পেতে যাচ্ছি। আর তার পরিণতি ভোগাতে পারে যুগ যুগ। কারণ বিশৃঙ্খল যুবসমাজ নিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন কোনোভাবেই সম্ভবপর হতে পারে না।
কিশোর গ্যাংয়ের বেড়ে ওঠা নিয়ে অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে নানাবিধ কারণ। তার মধ্যে কথিত বড় ভাই সুলভ আচরণ, যা অপেক্ষাকৃত ছোট যারা তারা তাদের নেতৃত্ব কিংবা আধিপত্য মানতে নারাজ। স্বাভাবিক প্রত্যাশিত সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ বা সমীহ আদায় করতে উঠেপড়ে লাগার কারণেও এই গ্যাং কালচার গড়ে ওঠে বলেও ধারণা করা যায়। আবার এ বড় ভাইদের আশ্রিত হয়ে সেই কথিত ছোট ভাইরা নানা অপকর্ম করলে পরে শেল্টার দিয়ে থাকে। এতে আরও প্রশ্রয় পেয়ে বেশিমাত্রায় বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আবার এক গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের দ্বন্দ্বও প্রকট হয়ে থাকে। তাদেরই আবার নামে-বেনামে সক্রিয় গ্রুপ চালু রয়েছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মিডিয়ার বরাতে আমাদেরও জানা হয়ে যায়। তবে সামাজিক অসংগতিকেও কেউ কেউ দুষছেন। যার কারণ এ কিশোরদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জিভ‚ত হয়ে তারাই আবার গ্যাং তৈরি করে। তবে বিদেশি সংস্কৃতিও কম দায়ী নয়। সেখানে কিছু সিনেমাটিক অ্যাকশন দৃশ্য তাদের অবাধ্য, অশ্লীলতা, অস্ত্রবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ইভটিজিং, শঠ, প্রতারণা, মাদকের ব্যবহার, নারীর স্বল্পবসনা দেহের উন্মুক্ত ছবি, খুনখারাবি এবং রগরগে দৃশ্য দেখিয়ে উন্মত্ত করে তোলে। স্যাটেলাইট মিডিয়ার যুগে শিশু-কিশোররা এসব মারদাঙ্গা সিনেমা দেখে নিজেকে সেভাবে কল্পনা করে থাকে। এমনও দেখা গেছে, আপন ভাইকে মেরে নিজের অবস্থান জানান দিতেও, যা ব্যাপকভাবে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিয়েছে এই অপরাধপ্রবণতার দিকে ঝুঁকতে।
আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে উঠতি বয়সি ছেলেরা অনেকটা স্বাধীনচেতা হয়ে থাকে। তারা পরিবার তথা অপরের অনুশাসন মানতেও নারাজ। আর তাই পরিবারের সামান্য কঠোরতাও তারা হজম না করে বহিঃজগতে পা বাড়ায়। আর এতে তার আশ্রয়দাতা হয় আরেক গ্যাংয়ের দলনেতা। এ ক্ষেত্রে তার সেই অর্থে কোনো বিবেকবোধ কাজ করে না। বয়সের কারণে এমনিতেই তারা আবেগনির্ভর হয়ে থাকে। যদিও একটা পর্যায়ে তারা নির্দয় নিষ্ঠুর ও উশৃঙ্খল হয়ে ওঠে।
যত যা-ই কারণ উল্লেখ করি না কেন, কোনো কিছুই কি এই কিশোর গ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে? এখনই এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অচিরেই দানব আকার ধারণ করতে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
তবে পরিবার, সমাজ, শিক্ষালয় সব জায়গায় যেসব শিশু-কিশোর বুলিংয়ের শিকার হয়। তারাও পরবর্তী পর্যায়ে অপরাধে ঝুঁকে পড়ে এসব গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে। এই বুলিং কখনো ছোট কখনো বড়দের কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষকের কিংবা ক্লাসে পড়া না পারার ফলেও হয়ে থাকে। আর এতে কিশোররা হীনমন্যতায় ভোগে। ফলে তারা একসময় মনস্তাত্তি¡ক দিক থেকে অসহায় হয়ে এ গ্যাংয়ে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে।
আবার মা-বাবার অতি আহ্লাদী মনোভাবও কম দায়ী নয়। তারা সবসময় চাহিদার বেশি পরিমাণ জিনিসপত্র সরবরাহ করে। যদিও এতে তারা মনে করতে পারে সন্তান খুশি হয়ে ভালো কিছু করবে। আদতে তা আর হয়ে ওঠে না। মা-বাবা চায় সন্তান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শুধু তাদের দেখানো ও শেখানো পথ অনুসরণ করে। এতে তারা সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রাধান্য খুব কমই দিয়ে থাকেন। কারণ তারা চায় গৎবাঁধা কিছু। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থতা সন্তানকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয় অনেকাংশে। এতে সন্তান নিজের ভেতর শূন্যতা অনুভব করে আর অপরাধ জগতে পা বাড়াতে থাকে। একসময় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এ সময় তারা কার সঙ্গে মিশছে, সেদিকে খেয়াল না রেখে আরও কঠোরতা প্রদর্শন ক্রমেই মনোজগতে তাকে নিঃস্ব করে দেয়। আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অনেক সময় দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হতে পারে না। কিন্তু দায়সারা সচেতন কার্যক্রমেই সীমিত রাখে তাদের কার্যক্রম। অন্যদিকে অপরাধের গুরুত্ব থেকেও বেশি বলপ্রয়োগ অনেক সময় আরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো কখনো সামাজিক বৈষম্য কিংবা অর্থনৈতিক বৈষম্যও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ। একই বয়সি একজন ভালো পরিধেয় বস্ত্র ভালো খাবার খাচ্ছে, যা তার কাছে ব্যাপক ঈর্ষার কারণ হতে পারে। আর এ অভাব থেকে বের হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় শিশু-কিশোররা রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় নিজেকে আবিষ্কার করে। তাদের কাজ মিছিল, মিটিং, শোডাউন ভাঙচুর করে আয়ের উৎস তৈরি করে।
কিশোরদের গ্যাং হিসেবে উপস্থাপনে যতটা না তারা দায়ী তার চেয়ে মনে হয় সমাজ তথা পারিপার্শ্বিক অবস্থাও কম দায়ী নয়। একজন শিশু তার শৈশবের সত্তা পরিত্যাগ করতে শুরু করে তখন তার ভেতর এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করে। সে নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করে। অথচ তারই কিছুটা বয়সে বড় আরেক কিশোরই তাকে যখন অবদমন করতে চায় তখনই তার সে সত্তা জানান দেয় মনের ভেতরকার অনুভূতি এবং না মানা একটা ব্যাপার কাজ করে। শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বে পড়ে তারা তৈরি করে নিজস্ব বলয়। আর এ বলয় যখন বেপরোয়া কিংবা অতি বেপরোয়া আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তখনই তাদের কিশোর গ্যাং নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তারা বেড়ে ওঠে কোনো না কোনো তথাকথিত বড় ভাইয়ের অধীনে। আর শুরু করে অসামাজিক কার্যকলাপ। চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন খারাবির মতো সামাল না দিতে পারা ঘটনাও। আর আশ্রয় খুঁজে অপরাধ জগতের মাফিয়ার কাছে। মাফিয়াদের ছত্রছায়ায় তারা হয় নিঃশেষ হয়ে যায়। আর নয়তো নেতা বনে যায়। শুরু হয় আধিপত্যের লড়াই। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চাঁদাবাজি লুটতরাজ টেন্ডারবাজি তো করেই। এসব করেই খুঁজে ফেরে আয়ের উৎস। পরিবারের উচ্ছন্নে যাওয়া সেই শৈশব পেরোনো কোমলমতি সারল্য ভরা নিষ্পাপ অবয়বের চেহারার কিশোর ছেলেটি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। গ্রহণ করে ইয়াবা, এলএসডি, পেন্টাগন, গাঁজা, আফিম কিংবা আরও ভয়াবহ রকমের কিছু। তখন তারা আর পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অপরাধ জগতে জড়িয়ে তখন তারা মর্যাদা খুঁজে ফেরে। জড়িয়ে পড়ে অপহরণ কিংবা চোরাকারবারির মতো রোমহষর্ক কোনো ঘটনায়।
গত কিছু দিন আগে ফেনীর একটা স্কুলের সমবয়সি বন্ধুদের মধ্যে মামুলি বিষয় নিয়ে বিরোধ হলে এ কিশোররাই অপর বন্ধুকে বেধড়ক পিটিয়ে জখম করে, যা সেই নির্যাতনের শিকার কিশোর ছেলেটি পরিবারের কাছে চেপে যায়। কাউকে ঘটনার বিষয়ে কিছুই প্রকাশ না করলেও অপর কোনো সহপাঠী ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে অভিভাবকমহল। ভুক্তভোগী পরিবার অপরাধে জড়িত সেসব কিশোরদের ছবি দেখে শনাক্ত করে নাম-ধাম উল্লেখে থানায় এজাহার দিলে পুলিশ ও মিডিয়া তৎপর হয়। অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইন আমলে আনা হয়। তারপরও কি থেমে ছিল, এই অপরাধপ্রবণ কিশোদের তৎপরতা? আইন দিয়ে যত কঠোর ভ‚মিকাই গ্রহণ করা হোক না কেন, থেমে থাকেনি এদের উপদ্রব। আর এ উপদ্রব এতই মাত্রা ছাড়ানো, থেমে থেমে উঠে আসে আলোচনায়। মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচনা শুরু হলে পুনরায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তৎপর হয়।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
আপনার মতামত লিখুন :