একজন কিশোর যখন অপরাধ করে তখন তাকে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হয়। আইনি নির্দেশনা অনুসরণ করে বিজ্ঞ আদালত সেই অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন প্রদান করেন। বয়স বিবেচনায় জামিন পেলেও অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় তাদের বিষয়ে উদার মনোভাবের প্রদর্শন ঘটাতে দেখা যায়। কথা হচ্ছে, যদি হত্যা কিংবা অপহরণ বা গুম অথবা আরও চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটিয়ে যাতে অবলীলায় পার না পেয়ে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। একজন কিশোর ভুল করে কোনো অপরাধ করে ফেললে তাকে সংশোধনের নিমিত্তে সুযোগ দেওয়া হলেও অপরাধ পরিক্রমার জন্য নিশ্চয়ই তেমন সুযোগ পাওয়ার অধিকারী হবে না। একজন শিশু কিংবা কিশোর বয়স ভেদে অপরাধে জড়ানোর আগেই পরিবার তথা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য করলে এই বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর খুব কমই অপরাধ চক্রে জড়িত হওয়ার সুযোগ পায়। আবার কিশোর অপরাধে অভিযুক্ত করার আগেই সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করেও সে পথ থেকে নিবৃত্ত করা যেতে পারে। একজন কিশোরকে কিশোর অপরাধে সম্পৃক্ত হতে না দিলে তারা গ্যাং গঠন করতে পারবে না। আর গ্যাং না হলে কিশোর গ্যাং নিয়েও সমাজ এতটা ভীত হবে না।
এই কিশোরদের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনেও রয়েছে পরিবার সমাজ তথা রাষ্ট্রের অবহেলা। যা সবাই অস্বীকার করে যায় অবলীলায়। কেউই এদের কৃতকর্মের দায় নিতে চান না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখেছি এই কিশোররাই তাদের দলের একেকজনের জন্মদিন ঘটা করে পালন করে। আর তা উদযাপনের রীতিও পুরোপুরি ভিন্ন। যার বর্ণনা শুনলে বা দেখলে গা শিউরে উঠবে যে কারো। যেমন- যার জন্মদিন তাকে হাত পিছমোড়া বেঁধে কিছুটা দূর থেকে অনবরত ডিম নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। এতে সেই ডিম সজোরে ভুক্তভোগীর গায়ে লেগে ফেটে সারা শরীর আঠালো হয়ে যায়। আর তখন চোখে-মুখে মাথায় কেউ কালি কেউ আটা বা ময়দা মুখ বরাবর জোরে ছুড়ে মারে। এটা চলে অনবরত। এতে সেই কিশোর যতই আকুতি-মিনতি করুক, খুব একটা কাজে আসে না। নাছোড়বান্দা কিশোরের দল তাকে না ছেড়ে দিয়ে আরও উদযাপন করতে থাকে। একপর্যায়ে সবাই যখন ক্লান্ত হয় সেই কিশোর ছেলেটিকে টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। তারপর অনবরত ডুব এবং চুবানো। কখনো কখনো এতটুকুতেই হয়তো ক্ষান্ত দেয়। কখনো আরও বেশিকিছু। তার ওপর আছে শাস্তির খড়গ! আবার আর্থিক ক্ষতি হয় এই খরচ কিংবা জন্মদিনের পরবর্তী সেলিব্রেশন হচ্ছে, পেটপুরে খাওয়ার আয়োজন। সেই টাকাও নিশ্চয়ই যার জন্মদিন তাকেই বহন করতে হয়।
জানা যায়নি এই যে খরচ তারা কোথায় পায়? কীভাবে সংগ্রহ করে? এভাবে একেকদিন একেকজনের জন্মদিনের এই উদযাপনের ভীতিকর মহড়া চলে। এদের চুল কাটানোর ধরন যেমন একই। তেমনই পোশাক পরিচ্ছদও। দেখা যায়, এদের হাঁটাচলা কথাবলা বাচনভঙ্গি সব একই ধরনের। কিন্তু এরা বেপরোয়া! এসব কি থামানো যাবে?
আবার এরা যখন চলাফেরা করে আমার কাছে মনে হয়েছে, পোনামাছের মতো করে চলে। একজন যেদিক যায় অন্যরাও একই দিকে ধায়। ঠিক কী কারণে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কিছুই জানে না। ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের বিচরণ! কোথাও অপরাধ করবে মনস্থির করলে সঙ্গে কেউ না জানলেও ক্ষতি নেই! একজন যা করে অন্যরা না জেনে না বুঝে ঠিকই সেই কাজ করে যায়। তাদের মারপিটের ধরন দেখলে মনে হবে একদল নেশাগ্রস্ত অথবা বিকারগ্রস্ত ছেলেপুলেদের এমন কাণ্ডকীর্তি। যা কোনো সভ্যসমাজের লোক দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠবে নিশ্চিত করেই বলে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত গত কিছুদিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সারা দেশে অন্যূন ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন। যা শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পাঠে জানা গেছে।
এসব কিশোর চটকদার নামে গ্যাং পরিচালনা করে থাকে বলেও জানা যায়। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, একই পাড়া-মহল্লার বাসিন্দা অথবা বখে যাওয়া কিশোর-তরুণেরা এক জোট হয়ে বাহারি ও চটকদার নামে এসব কিশোর গ্যাং তৈরি করে ও পরিচালনা করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওই নামে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ‘আইডি’ খোলা হয়। যেমন- রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে ইত্যাদি। এখন আরেকটি কালচার শুরু হয়েছে টিকটক সেলিব্রিটি। তার ওই কিশোর গ্যাং সদস্যদের স্বপ্ন পুরুষ হয়ে থাকে। এসব টিকটকরা যেখানে জড়ো হয় এই বয়সী কিশোররা সেখানে মুহূর্তেই ভিড় জমিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিতেও সময় লাগে না।
বিভিন্ন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিগ বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান এবং ত্রি গোল। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং। এই জাতীয় ভয়ংকর নাম ধারণের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিমত্তার প্রথম ধাপ প্রকাশ ও প্রচার করে থাকে। তারা প্রতিনিয়ত খবর ও খবরের শিরোনামে উঠে আসে।
ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড নামের কিশোর গ্যাং রয়েছে। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় অদ্ভুত সব নামে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করছে বলে পুলিশ এর আগে জানিয়েছে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে পড়ালেখার বাইরেও খেলাধুলা, নাটক, ভ্রমণ, লেখালেখি, বক্তৃতা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, পাঠক্রম আয়োজন, পাঠাগারপ্রথা ফিরিয়ে এনে এবং স্কাউটিংয়ের মতো সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের আরও বেশি বেশি করে সম্পৃক্ত করা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে- এমন অ্যাপস চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া। এসব বিবেচনায় নিলে কিছুটা হলেও রোধ করা যেতে পারে কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধ পরিক্রমা।
পাড়া-মহল্লাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখা এবং কিশোর গ্যাংয়ের ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। তাদের কোনোভাবেই যাতে সংগঠিত হতে না পারে সেদিকটায় খেয়াল রাখা। জুমার নামাজে খুতবায় কিশোর গ্যাংয়ের কুফল এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নিয়মিত বয়ানের পদক্ষেপ নেওয়া এবং স্কুল-কলেজে কিংবা টেলিভিশন মিডিয়ায় এর ভয়াবহতা ও কুফল সম্পর্কে প্রচার করা যেতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে কাউন্সেলিং করেও তাদের ভালো পথে ফিরিয়ে আনা সহজ হবে।
কিশোর সংশোধনাগারের পরিবেশ শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক হওয়া। সংশোধনাগারে যেন মানসিক নির্যাতন ও টর্চার সেলে পরিণত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। আরও বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেল রেস (গতির লড়াই) করে, এ বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। এসব করতে উঠতি বয়েসী ছেলেদের নিরুৎসাহিত করা। কিশোর গ্যাং সৃষ্টির কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গবেষণা করা প্রয়োজন। তারপর ওই গবেষণা কাজে লাগিয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখাও সহজসাধ্য হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, তারা আমাদেরই সন্তান। এই দেশের সম্পদ। সঠিক যত্নের ফলে তারা দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেই তাহলে একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। দেশ মহা সংকটে পতিত হতে পারে। সেই আবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে আলোর পথে ফেরানো আমাদের নৈতিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। যার সুফল দেশের মানুষই ভোগ করবে। তেমনটাই প্রত্যাশা করি।
আপনার মতামত লিখুন :