ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪

সড়কে নৈরাজ্যের দায় কার

আমীন আল রশীদ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০১:০৬ পিএম

সড়কে নৈরাজ্যের দায় কার

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পাঠক, একবার মনে করে দেখুন তো সেই ২০১৮ সালের কথা। সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি, অভিনেতা এমনকি পুলিশের গাড়ি আটকে দিয়ে কাগজপত্র এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করছে যারা, তাদের বয়স ২০-এর বেশি নয়। অর্থাৎ অধিকাংশই কিশোর-তরুণ। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এই দৃশ্যগুলো প্রথম দেখা গিয়েছিল ২০১৮ সালের আগস্টেই। তার সোয়া তিন বছর পরে আবারও সেই একই দৃশ্যের অবতারণা হয়।

২০২১ সালে স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরে শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছিল রাস্তায়। তারা সড়ক অবরোধ করে, সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সড়কে নৈরাজ্য বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ করেছে। বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার দাবি করেছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো বন্ধ তাদের সহপাঠী নিহতের বিচার দাবি করেছে। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, তারা একটি পুলিশ ভ্যান আটকে পুলিশের সঙ্গে তর্ক করছে, কারণ ওই গাড়ির লাইসেন্স নেই। একজন পুলিশ কর্মকর্তা তখন তাদের বলেছেন, এই গাড়িটির বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হবে।

দৃশ্যগুলো সিনেমায় হলে আরও ভালো হতো। বাস্তবে কাক্সিক্ষত নয়। এই দৃশ্যগুলোর ভেতরে রোমান্টিসিজম আছে। উত্তেজনা আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার উপাদান আছে। সেই বাস্তবতা এখনো বর্তমান। কিন্তু সেই সঙ্গে কিছু প্রশ্নও আছে যে, আমরা সন্তানদের ঠিক এভাবে রাস্তায় দেখতে চাই কি না? যদি উত্তর হয় ‘না’, তাহলে পাল্টা প্রশ্ন আসবে, কেন সড়কের নৈরাজ্য ঠেকাতে তাদের রাস্তায় নামতে হলো? সড়কে নৈরাজ্য ঠেকানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের, তারা কী করছে? তারা কি নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই এই তরুণদের ক্লাস বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে হয়? এই অনাকাক্সিক্ষত দৃশ্যটির অবতারণা হলো কাদের ব্যর্থতার কারণে?

২০১৮ সালের কিছু দৃশ্য মনে করা যেতে পারে, পুলিশ প্রটোকলে মন্ত্রীর গাড়ি। সাদা গাড়ির ভেতরে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। সড়কে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা থামিয়ে দিল। তারা জানতে পারল খোদ মন্ত্রীর গাড়ির চালকেরই লাইসেন্স নেই, অথবা লাইসেন্স সঙ্গে নেই। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে মন্ত্রী মহোদয় সাদা গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। পেছনে থাকা কালো রঙের আরেকটি গাড়িতে উঠে রওনা হলেন।

একইরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন দেশের ছাত্র-আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, ঊনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক তোফায়েল আহমেদ। তার গাড়িটি উল্টোপথে যাচ্ছিল সেসময়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আটকে দেয়। যদিও তোফায়েল আহমেদ গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্যই উল্টোপথে এসেছেন।

ওই বছরও পুলিশ তাদের নিজের বাহিনীর গাড়ির বিরুদ্ধেই মামলা দিয়েছিল। ছাত্ররা তখন সরকারের অন্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এমনকি গণমাধ্যমের গাড়ি আটকে দেয় এবং গাড়ির ফিটনেস ও চালকের লাইসেন্স না থাকলে সেই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দিতে বাধ্য করে। কিছু গাড়ি ভাঙচুরও করা হয়। ওই বছর তারা রাস্তায় নেমেছিল সড়কে তাদের দুই সহপাঠীর নির্মম মৃত্যুর প্রতিবাদ জানাতে। সেই প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওই প্রতিবাদের তিন বছর পরে তাদেরকে আবার কেন একই দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়েছিল? ২০১৮ সালে তারা প্ল্যাকার্ডে লিখেছিল- ‘রাষ্ট্রের মেরামত চলছে; সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।’ কিন্তু রাষ্ট্রের মেরামত যে ঠিকমতো হয়নি, তার প্রমাণ হলো একইরকমের প্ল্যাকার্ড নিয়ে সেই কিশোর-তরুণরা আবারও রাস্তায় নামে ২০২১ সালে।

ওইবারের ঘটনার পেছনে শুধু সড়কে সহপাঠীর নিহত হওয়ার ঘটনাই নয়, বরং গণপরিবহনে হাফভাড়ার দাবিটিও যুক্ত হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফভাড়া না নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে গণপরিবহন, বিশেষ করে বাসের মালিকরা দাবি করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই গরিব। পরিবহন ব্যবসায়ীরা গরিব- এই কথার ভেতরে যতটা না বাস্তবতা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রসিকতা। ফলে সেই রসিকতার উৎস সন্ধানে নেমেছেল দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক। এরইমধ্যে একজন পরিবহন মালিকের ব্যাপারে তথ্য বেরিয়ে এসেছিল যে, তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন একটা বাস দিয়ে। এখন তার বাসের সংখ্যা আড়াই শ’। আড়াই শ’ বাসের মালিকও এই দেশে গরিব!

এসব রসিকতাও অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। যেমন, এক লিটার তেলে একটি বাস কতদূর যায়? একটি বাসে কতজন যাত্রী থাকেন এবং এক লিটার তেলের দাম একটু বাড়ে তবে কত শতাংশ বাড়তি হিসাবে সর্বোচ্চ কত টাকা বাড়তি আদায় করা সংগত? এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাবে না। বর্তমান সরকারের আমলে দুই দফা জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাস বা গণপরিবহনে ভাড়া কমেনি। উপরন্তু, রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় যেসব বাস চলে, তার সবগুলো তো তেল বা ডিজেলে চলে না। সিএনজিতে চলে যেসব বাস, তারাও কেন বাড়তি ভাড়া নেবে? আর শিক্ষার্থীরা তাদের আইডি কার্ড দেখিয়ে তো বছরের পর বছর ধরে হাফভাড়া দিয়েই আসছিলেন।

নানা ঘটনায়, নানা অজুহাতে পরিবহন মালিকরা সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা নেন। সম্প্রতি খোদ জাতীয় সংসদে একজন সংসদ সদস্য যিনি পরিবহন ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত, তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন যে, গত সরকারের আমলে তারা বিভিন্ন সময়ে কোটি কোটি টাকা প্রণোদনা পেয়েছেন। যে রাষ্ট্রে বেসরকারি পরিবহন মালিকরা সরকারি প্রণোদনা পান, সেই পরিবহন মালিকরা কী করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ  ভাড়া নিতে অস্বীকার করেন- তা বোধগম্য নয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা বাসে যে হাফ ভাড়া দেয়, এটা নতুন কোনো বিষয় নয়।

বস্তুত, আমাদের গণপরিবহন ও গণপরিবহন ব্যবস্থা সারা বছরই গণমাধ্যমের শিরোনামে থাকে। এত বেশি নৈরাজ্য রাষ্ট্রের আর কোনো সেক্টরে সম্ভবত হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বী বাসের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো এবং বাসের ভেতরে থাকা সব যাত্রীর জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা; ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ; রাস্তার মাঝখানে কোনো নারী উঠতে চাইলে তাকে না নেওয়া; নারী বা বৃদ্ধকে নামানোর জন্য গাড়ি পুরোপুরি না থামানো; ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা; লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অমানবিক লোকদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া; বাসের ভেতরে একা কোনো নারী থাকলে তাকে ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করাসহ পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এ রকম অভিযোগের অন্ত নেই। বছরের পর বছর ধরে চলছে এসব নৈরাজ্য- যা বন্ধের মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। তারা তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে? করছে না যে, তার প্রমাণ ২০১৮ সালের বিক্ষোভের সোয়া তিন বছর পরে ২০২১ সালে একই দাবিতে আবারও রাজপথে শিক্ষার্থীরা নেমেছিল- যে কাজটি তাদের করার কথা নয়। রাস্তায় পুলিশের গাড়ি থামিয়ে ছাত্ররা গাড়ির কাগজ ও লাইসেন্স পরীক্ষা করবে, এটি শোভন নয়। এই অশোভন কাজটি করার জন্য কেন তাদের রাস্তায় নামতে হলো, সেই জবাব রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।  

প্রশ্ন হলো, শিশু-কিশোররা কি রাষ্ট্রকে তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, কেউই তার কাজটা সঠিকভাবে করছে না? যে পুলিশ গাড়ির ফিটনেস আর ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করবে, তাদেরই লাইসেন্স নেই। যে গণমাধ্যম সমাজের অসংগতি তুলে ধরবে, তাদের গাড়িই নিয়ম মেনে চলে না। যে মন্ত্রীরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করেন, তারাই উল্টো পথে চলেন। তাদের চালকেরই লাইসেন্স নেই! এখানে ভয়াবহ দুর্নীতি ও অনিয়ম, যে অনিয়মের বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে শিক্ষার্থীরা বলেছে, তারা জাস্টিস চায়। তারা লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের গাড়ির চালকের বিরুদ্ধেও মামলা দিতে বাধ্য করে। এই দৃশ্য ২০১৮ সালের আগে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ দেখেনি। এ এক অদ্ভুত বাস্তবতা; ভুক্তভোগীদের জন্য এ এক করুণ অভিজ্ঞতা। যারা বছরের পর বছর মনে করে আসছিলেন তারা সব নিয়মকানুন আর আইনের ঊর্ধ্বে, তাদেরকেও রাস্তায় নাজেহাল হতে হয় তাদের সন্তান এমনকি নাতিতুল্যদের কাছে। এই দৃশ্য তো কাক্সিক্ষত নয়।

প্রশ্ন হলো, সড়কে নৈরাজ্য কেন থামে না? এর পেছনে অনেকগুলো কারণ ও ফ্যাক্টর রয়েছে। একটি বড় কারণ পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা খুবই প্রভাবশালী। ক্ষমতায় যেতে এবং ক্ষমতায় থাকতে নানাভাবেই তাদের কাজে লাগানো হয়। সুতরাং রাষ্ট্র যাদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া কঠিন। তাছাড়া দেশের রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদেরও অনেকে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাদের বিরাট ভোটব্যাংক রয়েছে। উপরন্তু গণপরিবহনগুলোর পরিচালনার পদ্ধতিটিই এমন যে, এখানে চালকরা প্রতিদ্বন্দ্বী বাসের সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেই।

আরেকটি বড় সমস্যা, দেশে যে পরিমাণ গণপরিবহন, সেই পরিমাণ দক্ষ চালক নেই বা তৈরি হয় না। ফলে মালিকরা তাদের ব্যবসার স্বার্থে সব সময়ই পরিবহন শ্রমিকদের তোয়াজ করে চলে। মালিকরা একটু কঠোর হলেই তারা চাকরি ছেড়ে দেয়। ফলে ব্যবসায় ক্ষতির আশঙ্কায় মালিকরা অনেক সময় বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের অন্যায় মেনে নেয়। আবার অনেক সময় মালিকের অতিলোভ, শ্রমিকদের ঠকানো ইত্যাদি কারণেও চালক ও হেলপাররা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সমস্যাটা নানামুখী। এসব সমীকরণ যতদিন থাকবে, ততদিন গণপরিবহনের নৈরাজ্য বন্ধের জন্য রাস্তায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ, মাঝেমধ্যে গাড়ি জ¦ালিয়ে দেওয়া, টেলিভিশনে টকশোতে জ¦ালাময়ী বক্তৃতা কিংবা পত্রিকার পাতায় বড় নিবন্ধ ছাপা হবে ঠিকইÑ সড়ক-মহাসড়কে জীবনের অপচয় রোধ করা তো অনিশ্চিতই থেকে যায়।

কোটি কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানানো হয়, বিদেশ থেকে ঝকঝকে গাড়ি আনা হয়; কিন্তু সেই ফ্লাইওভার, সেই সড়ক কিংবা সেসব সেতুতে যারা গাড়ি চালাবেন, অর্থাৎ যাদের হাতে স্টিয়ারিং, তারা কতটা দক্ষ, যোগ্য, তারা কোন প্রক্রিয়ায় স্টিয়ারিং ধরলেন এবং সর্বোপরি তারা কতটা মানবিক- সেই প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে বেশি জরুরি। দক্ষ ও মানবিক চালক তৈরিতে রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব পালনের কথা;  যে ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের জন্য যেরকম দুর্নীতিমুক্ত একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা- তা কি স্বাধীনতার এত বছর বছরেও গড়ে তোলা গেছে?

আরবি/এফআই

Link copied!