ঢাকা বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে কেন উদাসীনতা

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৩:৪৬ পিএম

ডেঙ্গুতে মৃত্যু নিয়ে কেন উদাসীনতা

ছবি: রুপালী বাংলাদেশ

আমাদের দেশ হচ্ছে একটা সমস্যার ডিপো। একটা সমস্যা সামনে আসতে না আসতেই নতুন আরেক সমস্যা এসে পুরোনোটাকে আড়াল করে দাঁড়ায়। তারপর আরেকটা। এভাবেই চলছে। বর্তমানে অন্যসব সমস্যার পাশাপাশি ডেঙ্গু সমস্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বলা যায় ডেঙ্গু এখন আমাদের দেশে একটি স্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হতে চলেছে। প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আগের বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৮৬ হাজার ৭৯১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪৫৯ জনের। প্রতিদিন এক হাজারেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ-আয়োজন চোখে পড়ছে না। রাষ্ট্রসংস্কারের বিশাল কর্মযজ্ঞের চাপে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন চাপা পড়ে গেছে। এ বছর ডেঙ্গুজ¦রবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সিটি করপোরেশনগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় নাগরিকসেবা কার্যক্রম তলানিতে পৌঁছেছে।

সরকার সঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলছে। যে সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়, সেটাও ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে। ঢাকা শহরের নাগরিকদের এখন ডেঙ্গুর প্রকোপে চরম মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে।

গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, নো দাই সেলফ। মানে হচ্ছে, নিজেকে জানো। এখন দেশে যে পরিস্থিতি তাতে নিজেকে জানলে আর হচ্ছে না। এখন বেঁচে থাকতে হলে, টিকে থাকতে হলে আরও অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে হয়। সবচেয়ে বেশি জানতে হয়, মশাকে। সক্রেটিস বেঁচে থাকলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিশ্চিত বলতেন, মশাকে জানো।

সারা দেশের মানুষ বর্তমানে মশার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ বিস্তারের মূল কারণ মশা। মশা মারার ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কারণেই এখন ডেঙ্গু নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু ৫৫ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।  সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী উপচে পড়ছে। আসন মিলছে না। মিলছে না আইসিইউ সেবা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন, আরও অন্তত দুই মাস ডেঙ্গুর আগ্রাসী থাবা চলমান থাকবে।

আমরা জানি, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের একাধিক প্রকরণ থাকার কারণে একই ব্যক্তি একাধিকবার ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হতে পারেন এবং সেক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি অনেকগুণ বেশি। যেহেতু ডেঙ্গু জ¦রে প্রচলিত কোনো প্রতিষেধক টিকা নেই। তাই মশক নিধন ও মশার কামড় থেকে পরিত্রাণই হলো সর্বোত্তম পথ। তার মানে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে আমাদের মশা মারতে হবে। কিন্তু মশকনিধন বা মশা মারা কোনো সহজ কাজ নয়। কারণ মশার মতো বেহায়া প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই। একে থাপ্পড় মারলেও কানের কাছে চলে আসে গান শোনাতে!

ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের মূল কারণ মশাকে অবজ্ঞা করা। আমাদের রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা, সংস্কার, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, তাদের অনুগ্রহ লাভ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে যতটা মাথা ঘামান, মশা নিয়ে তার তিল পরিমাণও ঘামান না। মশাকে সব সময় তুচ্ছ এবং অবহেলা করা হয়। অথচ জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব মশার শতকরা মাত্র ৬ ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায়, মানুষের রক্ত খায়। এই ৬ ভাগের অর্ধেক, অর্থাৎ মাত্র শতকরা ৩ ভাগ মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই ৩ ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে!

বিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস, কিন্তু মশাটা মারবে কে? মশা মারতে কামান দাগা ছাড়া আমাদের কর্তাব্যক্তিরা সম্ভাব্য সব কিছুই করছেন বলে দাবি করেন। অবশ্য ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে উদ্যোগ-আয়োজনের চেয়ে ঢাকঢোল পেটানো হয় বেশি। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

আমাদের দেশের ক্ষমতাবানরা যেমন- রাষ্ট্রীয় অর্থ মেরে দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রক্রিয়া বের করেন, মশারাও টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে চলে। পরিবেশগত অবস্থার কারণে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার জীবনচক্রে পরিবর্তন এসেছে। এতদিন বিশেষজ্ঞরা দিনের শুরুতে ও সন্ধ্যার আগে এই মশা কামড়াত বলে দাবি করলেও, নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এডিস মশা এখন রাতেও কামড়াচ্ছে। এর ফলে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের মতো ঘাতক হিসেবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মশাটি।

সারা বিশ্বে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কীটতত্ত্ববিদরা এ কাজে নেতৃত্ব দেন। গবেষণা করে মশার বিস্তারের নানা দিক খুঁজে বের করা হয়। এরপর কাজে নামে কর্মী বাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশে পুরো উল্টো চিত্র। সিটি করপোরেশনগুলোতে কীটতত্ত্ববিদ নেই, গবেষণাগারও নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি। এই সুযোগে মশা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী রোগ।
দেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা (কিউর) মোটামুটি ভালো চললেও এর প্রিভেনশনটা কিন্তু ঠিকঠাকমতো করা যাচ্ছে না। সুতরাং মশা নিধনে (প্রিভেনটিভ মেজার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নতুন করে ভাবতে হবে। মশা এখন দেশের বড় সমস্যা; ভবিষ্যতেও মশার উপদ্রব থাকবে। এজন্য সামগ্রিকতা বিবেচনায় মশা নিয়ন্ত্রণে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দরকার।

মশানিধনে সিটি করপোরেশন শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলেও (যেমন- রুটিন করে সকাল-বিকেল বিভিন্ন ওয়ার্ডে কীটনাশক স্প্রেয়িং ও ফগিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা) প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপারেশন টিম বা যারা স্প্রে করছে তারা কি জানে কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাদের কাছে কি কোনো কীটনাশক প্রতিরোধী পরীক্ষিত ডেটা রয়েছে, যা দেখে তারা রিকমেন্ডেড ডোজ প্রয়োগ করতে পারে? নাকি তারা মশা মারার জন্য কীটনাশকের ডোজ নিজেরাই ঠিক করছে বা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিচ্ছে? কিংবা যারা কীটনাশক প্রয়োগ করছে তারা কি ঠিকঠাকমতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার মশা এখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে কীটনাশকে আর মশা মরছে না। যদি কীটনাশকে ভেজাল না হয়, তাহলে অল্প ডোজে কাজ হওয়ার কথা। তবে সাধারণত কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই (অতিরিক্ত ডোজ/অদক্ষ স্প্রেয়ারম্যান) মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।

মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে পি-৪৫০ জিনকে (প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদেরকে আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখান থেকে অনুমেয়। তাই, বিভিন্ন টার্গেট এরিয়ায় মশা কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসটেন্স রেশিও) কেমন তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। নিয়মিত ও রুটিনমাফিক গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কোনোদিনই টেকসই হবে না।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারকে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। অগ্রাধিকারের তালিকায় এডিস মশা নিধনকে যুক্ত করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ, সংস্থা এবং সরকারের কাজের সক্ষমতা ও সমন্বয় বাড়াতে হবে। মানুষের মৃত্যু নিয়ে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। 

আরবি/জেআই

Link copied!