ঢাকা বুধবার, ০১ জানুয়ারি, ২০২৫

অস্তিত্ব নিয়ে উপহাস কেন

চিররঞ্জন সরকার

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪, ১০:৩৪ এএম

অস্তিত্ব নিয়ে উপহাস কেন

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে দেশের ছাত্র-জনতা গত আগস্টে মরণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। সরকার পতনের পর আশা করা হয়েছিল, দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। ব্যবস্থা বদল হবে। সব ধরনের অন্যায়-অবিচার-স্বৈরতন্ত্রের অবসান হবে। যারা এ ক্রান্তিকালে দেশ শাসনের ভার গ্রহণ করেছিলেন, তারা তেমন স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু গত সাড়ে চার মাসে মনে হচ্ছে, আমরা যেন উলটো পথে যাত্রা করেছি। কোথাও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সবখানে সমান নৈরাজ্য। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। খুন-চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই অবাধে চলছে। প্রশাসনে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা। রাস্তাঘাটে নিয়ন্ত্রণহীন যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে। ব্যস্ত সড়ক অবরোধ করে মিছিল, ঘেরাও চলছে বল্গাহীন। বাজারে কোনো স্থিরতা নেই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তো বাড়ছেই। এর মধ্যে চলেছে উন্মত্ত গোষ্ঠীর বেপরোয়া তৎপরতা বা মব রুলিং।

৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের আদর্শিক মুখটাই যেন ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের মূল চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। একটা দেশকে আদর্শিক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়ে এখন শুরু হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপমান। ৫৩ বছর আগে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল, তেমন একজন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই বীর প্রতীককে গলায় জুতার মালা পরিয়ে অপমান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রকাশ্যে গলায় জুতার মালা পরিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত একটি দলের বিশেষ কর্মীরা। এটা অত্যন্ত জঘন্য ও নিন্দনীয় কাজ! মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের কথা না-ই বললাম, দেশের একজন প্রবীণ নাগরিকের গলায় জুতার মালা পরানো, মারধর করা রীতিমতো অসভ্যতা। এটা কোনো যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। 
অনেকে এ অসভ্য ঘটনাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে সমর্থন করছেন। বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই বীর প্রতীক একজন আওয়ামী লীগের নেতা। তার বিরুদ্ধে থানায় ৯টা মামলা আছে। প্রশ্ন হলো- কেউ আওয়ামী লীগ করলেই তাকে পেটানো, অপমান করা, জুতার মালা পরানো জায়েজ? আওয়ামী লীগ কি নিষিদ্ধ সংগঠন? একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেই যে তার সাতখুন মাফ-এমন কথা কেউ বলবেন না। কেউ যদি সত্যিকার অর্থে অপরাধমূলক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকে, তবে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কিন্তু আইন হাতে তুলে নেওয়া, গলায় জুতার মালা পরানোটা চরম নৈরাজ্যের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কোনো সভ্য দেশে, সভ্য শাসনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। ঘটতে দেওয়া উচিত নয়।

ওই মুক্তিযোদ্ধার অপরাধ থাকলে, তার নামে মামলা হলে আইনের আওতায় আনা যেত, কিন্তু জুতার মালা কেন? এক স্বৈশাসকের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করে তবে আরেক স্বৈরতন্ত্রের দিকে আমরা যাত্রা করলাম? বিভিন্ন গণমাধ্যম অফিসে গিয়ে শাসানো, বীর মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানো এগুলো গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। সাংবাদিক বা মুক্তিযোদ্ধা বলেই নয়, দেশের কোনো মানুষকেই হেনস্থা করার অধিকার কারও নেই। এ ধরনের কাজ যারা করে তারা অপরাধী। অপরাধীদের বিচার করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

আবদুল হাই বীর প্রতীককে অপমান করার জন্য গলায় জুতার মালা পরিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা। এটা চরম ঔদ্ধত্য। যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, পরিণত বয়সে এসে তাকে এভাবে অপমান করাটা একটা প্রতীকী বার্তা। এই অপশক্তি দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কোন চোখে দেখে এবং তাদের সম্ভাব্য পরিণতিরও একটা হুমকি দিয়ে রাখল যেন!

ঘটনাটিকে কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধারা নিঃসন্দেহে এ দেশের সম্মানের প্রতীক। তাদের অপমান মানে মুক্তিযুদ্ধকেই উপহাস করা! এর পেছনে রয়েছে প্রতিহিংসার হিংস্র রাজনীতি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা গণহত্যায় সাহায্য করেছে, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে, পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর সেই ঘৃণ্য রাজাকার, আলবদর, আল সামসের কিছু সদস্যকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তিস্বরূপ জুতার মালা পরিয়ে এলাকায় ঘোরানো হতো। স্বাধীনতার ৫৩ বছর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে অপদস্ত করা মানে হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে অপমান।  

কারা তাকে অপমান অপদস্ত করেছে তাদের নাম এবং দলীয় পরিচয় পত্রিকায় এসেছে। ভিডিও আছে, ছবি আছে তারপরও তাদের ধরতে, বিচার করতে কেন সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দিতে হয়? আবার সেই নির্দেশে কেন উল্লখ করতে হয় যে ওই ব্যক্তির নামে হত্যা মামলাসহ ৯টি মামলা আছে! এটা কোন ধরনের প্রহসন? মামলা থাকলেই কি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে? মামলাগুলো কখন হয়েছে, সেটাও তো বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। আমরা দেখেছি, হাসিনা সরকারের পতনের পর হাজার ব্যক্তির নামে অসংখ্য মামলা কীভাবে কোনো রকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাহলে বিগত সরকারের আমলে করা মামলা ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন?

গত কয়েক মাসে আর কিছুর গুণগত পরিবর্তন হোক বা না হোক, দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার একটা সূক্ষ্ম প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভিলেন বানানোর সর্বত চেষ্টা করা হচ্ছে। কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গর্বিত মুখে কলঙ্কের কালিমা মেখে দেওয়া যায়, তারই আয়োজনে মেতে উঠছে সেই রাজিত শক্তি। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাবানদের একাংশ।

অথচ চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের সময় বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোনো দলের নয়, মুক্তিযুদ্ধ হবে সবার। অথচ এখন, এই নতুন সময়ে এসে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এমন বর্বর আচরণ দেখতে হচ্ছে আমাদের! এটা ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধই আমাদের আত্মপরিচয়, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। জাতি হিসেবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, যথাযথ সম্মান জানানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। রাজনৈতিক দল আসবে, যাবে। নিয়ত পরিবর্তন হতেই থাকবে, ক্ষমতার পালাবদলও হয়তো চলবে। কিন্তু বাংলাদেশ রয়ে যাবে। যে বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে। মূলত সুশাসনের জন্যই একাত্তরের পরে গত জুলাই-আগস্টে দেশে এত রক্ত ঝরেছে। এত উলট-পালট হয়েছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল পরিবর্তনের জন্য। প্রতিশোধের জন্য নয়। দেশকে অন্ধকারের দিকে নেওয়ার জন্য নয়। দেশকে যারা অন্ধকারের দিকে নিতে চায়, তাদের চিহ্নিত করে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আজ যারা মুক্তিযোদ্ধাদের জুতার মালা পরাচ্ছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করছে, ক্ষণিকের সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নানারকম অন্যায় করছে, তাদেরও কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে খেয়াল রাখা দরকার। তারা কি বেঁচে যাবেন? প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তা ভুলে যাওয়াটা হবে আত্মঘাতী!

আরবি/এফআই

Link copied!