ডেঙ্গু বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম। প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ বছরের শুরুর দিকে আক্রান্তের হার তুলনামূলক কম থাকলেও পরে বিগত বছরের ধারাই অব্যাহত রেখেছে। এখন সারা বছরই কমবেশি ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। এর সঙ্গে এবার নতুন যোগ হয়েছে চিকুনগুনিয়া।
এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬৯ জন। এর আগে ২০১৯ সালে দেশে এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমনভাবে দেখা না গেলেও, ২০২১ সালে সারা দেশে ২৮ হাজার ৪২৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১০৫ জন মারা যান। ২০২২ সালে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, এবং ওই বছর ২৮১ জন মারা যান।
ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া একসঙ্গে হতে পারে
এ দুটি একসঙ্গে হতে পারে, তবে ব্যাপারটি এখন পর্যন্ত বিরল। এ পর্যন্ত কিছু রোগী পাওয়া গেছে। আগেও বিচ্ছিন্নভাবে এ রকম একসঙ্গে ইনফেকশনের ইতিহাস আছে। বিভিন্ন দেশে কিছু কেস রিপোর্ট আছে, বাংলাদেশেও এ রকম কিছু রোগীর কেস রিপোর্ট হয়েছে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিরই বাহক একই মশা। একই সঙ্গে দুটি ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে এ রকম একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বাহক মশা একই সঙ্গে দুটি জীবাণু বহন করতে পারে। আবার ক্রস রিঅ্যাকটিভিটি নামক জটিল প্রক্রিয়ায় অ্যান্টিবডি থেকে এ রকম ঘটনা হতে পারে। সাধারণ উপসর্গগুলোই বেশি লক্ষণীয়। যেমন- জ্বর, মাথাব্যথা। এ ছাড়া শারীরিক দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, শরীরব্যথা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, এগুলোও থাকতে পারে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া দুটিতেই শরীরে র্যাশ দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া অনেক রোগীর শুরুর দিকে ডায়রিয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া একসঙ্গে হলে করণীয়
এ দুটিতে একসঙ্গে আক্রান্ত হলে তুলনামূলকভাবে রোগের প্রকোপ বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। দুটি ইনফেকশন আলাদাভাবে শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আলাদা আক্রান্তের তুলনায় একসঙ্গে রোগীর জটিলতা ও মৃত্যুহার সামান্য বেশি। তবে এ ব্যাপারে আরও অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষা
খুব টক্সিক না হলে কোনো জ¦রেরই তিনদিন আগে কোনো পরীক্ষার দরকার নেই। টিসি ডিসি হিমোগ্লোবিন ইএসআর, এসজিপিটি : ভাইরাল ফিভারে কাউন্ট বাড়ে না। যদি কাউন্ট কমে, বিশেষ করে টিসি তিন হাজারের নিচে নামে তাহলে ডেঙ্গু নিশ্চিত।
এনএস ১ জ্যান্টিজেন
এটাই জ্বরের প্রথম সপ্তাহের পরীক্ষা। জ্বর থাকাকালে পজিটিভ হয়।
অ্যান্টিবডি পরীক্ষা
সাতদিন পর পজিটিভ হয় বলে এটা কার্যকরী নয়। এনএস ১ অ্যান্টিজেন করা গেলে এটার দরকারও নেই।
প্লাটিলেট কাউন্ট ও হিমাটোক্রিট : প্লাটিলেট আতঙ্ক না থাকলে অত্যাবশ্যকীয় নয়। হিমোরেজিক ফিভার ডায়াগনসিস ও ফলোআপের জন্য করা লাগে। হিমোরেজিক ফিভার হলে পেট ও ফুসফুসে পানি নিশ্চিত করার জন্য পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বুকের এক্স-রে করার দরকার হয়।
নিউট্রিশন
জ্বরের সময় ক্ষুধামন্দা হয়, বমি লাগে। এ সময় ফলের রস উপকারী। স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং গ্রেড-১ হিমোরেজিকে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। গ্রেড-২ এ অতিরিক্ত সমস্যা হলো, প্রথমে ধরতে না পারলে চিকিৎসা না দিলে গ্রেড-৩ বা গ্রেড-৪ অর্থাৎ শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। পরিমিত পানি দিতে হবে জ¦র কমিয়ে রাখতে।
গ্রেড-২ তে যদি পেটের ব্যথা না কমে, বমি হচ্ছে, অথবা রক্তচাপ ঠিক থাকছে না, তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
রক্ত দেওয়া (ব্লাড ট্রান্সফিউশন)
রক্তক্ষরণ হলে নিয়ম হলো, রক্তবদল করতে হয়। সিস্টলিক ব্লাড প্রেশার ১০০-এর নিচে নামলে, পালস ১০০-এর বেশি হলে। হিমোগ্লোবিন ১০-এর নিচে নামলে ও হিমাটোক্রিট কমে গেলে রক্ত দিতে হবে।
প্রতিরোধ
মশা তাড়াতে ঘরে স্প্রে ব্যবহার করা যায়। তা ছাড়া ফুলহাতা কাপড় এবং পা-মোজা ব্যবহার করা যায়। দিনে মশারি দিয়ে ঘুমালে ভালো হয়। মশার ডিম থেকে লার্ভা হয়ে থাকে। তাই এই পাত্র মশার বংশবিস্তার রোধ করতে জলাধার, নির্মাণ সামগ্রীর পানি, বৃষ্টিতে জমে থাকা রাস্তা এবং পাত্রের পানিতে স্প্রে করা জরুরি।
পরিশেষে বলা যায়, এই শীতে ডেঙ্গুর উপদ্রব। তাই বছরের অন্য সময়ের চেয়ে এ সময়ে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। আর শীতকাল যেমন- মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাইও মোকাবিলা করতে হয়। তবে সঠিক রোগনির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধু বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই শীতকালে বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
আপনার মতামত লিখুন :