ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মামলা-হামলায় জর্জরিত আওয়ামী লীগ

জে আই জাহিদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৭:০১ পিএম

মামলা-হামলায় জর্জরিত আওয়ামী লীগ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই শুরু হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী কর্তা থেকে শুরু করে স্বৈরাচার পন্থীদের গ্রেপ্তার। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দুই ডজনেরও বেশি মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উপদেষ্টা ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এরই মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং শেখ হাসিনার সাবেক জ্বালানি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া সাবেক দুই আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হকসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিকে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার হাসিনার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে, এর মধ্যে বেশির ভাগই হত্যা মামলা। শুধু তাই নয়, গণহত্যা এবং অপহরণের মতো অভিযোগেও মামলা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। আর এসব মামলার আসামির তালিকায় বাদ যায়নি হাসিনা পরিবারের সদস্যরাও। মামলার আসামী হয়েছেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা ও রেহানার দুই সন্তান, রয়েছে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এমনকি মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামেও হয়েছে এসব মামলা। 

একইভাবে মামলার আসামীদের তালিকায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতাদেরও নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে গত পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাবার পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগ ও আত্মগোপনে চেষ্টা করেন তার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য।

আত্মগোপনে যাওয়ার সময় মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) দুপুরের দিকে সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। একই দিনে আটক হন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। যদিও পরে আবার মি. পলক, মি. সৈকত ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে একই দিনে খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সম্পর্কে এখনও কিছু জানায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এদিকে সেসময়ে গণমাধ্যমে খবর আসে, বিমানবন্দর থেকে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং ঢাকা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদকেও আটক করা হয়েছে। তবে, তাদের সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শুধু আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতাই নয়, দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, গুম ইত্যাদির মামলা করা হচ্ছে। তাদেরকে অনেককে টিপু মুনশির মতো গ্রেফতার করা হয়েছে, অনেককে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

এখন পর্যন্ত যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মণি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেননও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পরপরই সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং দলটির নেতৃবৃন্দ যেমন গ্রেপ্তার হয়েছেন, 
তেমনি সাবেক অনেক সরকারি কর্মকর্তাও আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল, যিনি এক সময় র‌্যাবে কর্মরত ছিলেন, তাকেও আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

তবে বাংলাদেশের কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যেভাবে মামলা, গ্রেপ্তারের ঘটনায় সমালোচনাও করছেন অনেকেই। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দেওয়া’ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও এক জায়গার ঘটনা নিয়ে গোটা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’ কোনও সারবস্তু নেই এমন ঘটনায় কেন্দ্রীয় নেতাদের জড়িত করে মামলা দেওয়া উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে মামলার পাশাপাশি গ্রেপ্তার করা আসামিদের কারও কারও ওপর আদালত চত্বরে হামলা বা মারধরের মতো ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ওপর ডিম ছোড়ার ঘটনা ঘটে। আদালত চত্বরে হেনস্তার শিকার হন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সিলেটে আদালত চত্বরে মারধরের শিকার হন গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ঢালাওভাবে এসব মামলা ও আসামি করা হলে যারা অপরাধ করেছেন অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতি করেছেন, তারাও আগের মতো পার পেয়ে যেতে পারেন বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

অন্তর্র্বতী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আদালতে যাওয়ার সময়ে কখনো কাউকে আক্রমণ করা উচিত নয়, কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমন ঘটনা যাতে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন কৌশল ও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’ ঢালাও মামলার বিষয়ে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কেউ মামলা করলে রাষ্ট্রের কোনো অধিকার নেই তা না বলার। এসব পুলিশ তদন্ত করবে, তদন্তে সুস্পষ্ট তথ্য না পেলে পুলিশ অব্যাহতি দিয়ে দেবে।’

উচ্চ আদালতে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন আইনজীবী খান খালিদ আদনান। তিনি গনমাধ্যমকে বলেন, হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে এজাহার বা নালিশি দরখাস্তে সুনির্দিষ্ট অভিপ্রায়-উদ্দেশ্য উল্লেখ করতে হয়। মামলাগুলোতে আসামিদের নামের পাশে শুধু হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা উল্লেখ করা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলায় যিনি গুলি করেছেন, তাকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়নি। যিনি গুলি করলেন, তাকে শনাক্ত না করা গেলে যিনি নির্দেশ দিলেন, তাকে আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত করা দুরূহ। যে কারণে এসব মামলা টেকার সম্ভাবনা খুবই কম।’

আরবি/এফআই

Link copied!