ব্রাহ্মণবাড়িয়া: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ ছিল মজলুম এবং রাস্তায় যে ভাইটি ভিক্ষা করতেন তিনিও মজলুম। কারণ ওই সব ভিক্ষুককে চাঁদা দিতে হতো গুণ্ডাদের কাছে। চাঁদা না দিলে তারা ভিক্ষা করতে পারতেন না। সারাদিন ভিক্ষা করে যা থাকত তা দিয়ে আবার সংসার চলতনা। কারণ ৩০ টাকার পেঁয়াজ ৩০০ টাকায় কিনতে হতো। ৫ আগস্ট আমাদের ছেলেরা নতুন করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। কিন্ত দূর্ভাগ্যবশত এখনো সে সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। দ্রব্যমূল্যর লাগাম টানতে হলে সিন্ডিকেট ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে হবে।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আব্দুল কুদ্দুস মাখন পৌর মুক্তমঞ্চে বি-বাড়ীয়া জেলা জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর একটি দলের ওপর যে রকম জুলুম করা হয়েছে বাংলাদেশের অন্য কোনো দলের ওপর সে জুলুম করা হয়নি। সে দলটার নাম হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু আমরা আগেই বলেছি আমরা কারো ওপর প্রতিশোধ নেব না।আমরা কেউ আইন হাতে তুলে নেব না। অর্থাৎ আমরা সামগ্রিকভাবে ক্ষমা করে দিতে চাই কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যে অপরাধ করেছেন ইনসাফের দাবি হচ্ছে তাকে তার অপরাধের শাস্তি পেতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা বৈষম্যহীন ও শোষনমুক্ত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এ জন্য আমরা ৪১ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছি। এর মধ্যে ১০ দফা অন্তর্তীকালীন সরকারের নিকট বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছি। আমরা একটি পরিপূর্ণ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যে বাংলাদেশে নারী, পুরুষ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোন মানুষ তার ন্যয্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেনা। বিভিন্ন জাতি ধর্মের মানুষ মিলেমিশে সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একটি অহিংসমূখ সমাজ গড়ে তুলবে- আমরা সে সমাজের স্বপ্ন দেখি। আমরা স্বপ্ন দেখি,প্রত্যেক আদম সন্তান তার মায়ের পেট থেকে জন্ম নেয়ার পরে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সকল অধিকার পাবে। তার বাঁচার অধিকার, তার চিকিৎসার অধিকার, তার শিক্ষার অধিকার। প্রত্যেকটি অধিকার রাষ্ট্র তাকে দিতে বাধ্য থাকবে। এরপর শিশু থেকে এসব টগবগে যুবক, যুবতি যখন লেখাপড়া করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসার পাঠ চুকিয়ে বের হবে তখন বেকারত্বের অভিশাপ তাকে গ্রাস করবে না। আমরা এমন একটি শিক্ষা আমাদের সন্তানদের হাতে তুলে দিতে চাই, যে শিক্ষা তাদেরকে নৈতিকবোধ সম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়র করে তুলবে,পাশাপাশি তাদের হাত কর্মীর হাতে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যে সমাজে একজন বিচার প্রার্থীকে আদালত প্রাঙ্গনে বিভিন্ন হয়রানীর শিকার হতে হবেনা। কোন বিচারক তার আসনে বসে আল্লাহকে ছাড়া আর কোন রাষ্ট্রশক্তিকে পরোয়া করবে না। রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী বিচার কার্য পরিচালনা করবে। আমরা এমন একটি বিচার ব্যবস্থা চাই, যে বিচার ব্যবস্থায় উচু নিচু কাউকে মাপা হবে না। বিচার প্রার্থীকে বিচার প্রার্থী হিসেবে দেখবে। কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ নিয়ে আদালতে হাজির হয়, তাহলে মিথ্যা অভিযোগ করার জন্যও তাকে দন্ড দিতে হবে। আবার যদি সঠিক অভিযোগ নিয়ে কেউ হাজির হয়, তাহলে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করে তাকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
আমীরে জামায়াত বলেন, আমরা এমন একটি দেশ চাই, যে দেশ অন্য কোন শক্তি বা দেশের অধীনতা মেনে নেবে না। পৃথিবীর অন্য দশটি দেশ যেমন মর্যাদার সাথে বিশ্বের সামনে মাথা উচু করে দাড়ায়, বাংলাদেশও তার শির উচু করে দাড়াবে ইনশাআল্লাহ। বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকবে, কিন্তু কোন প্রভূ আমরা মেনে নেব না। কেউ আমাদের প্রভুত্ব করতে আসলে জাতি তার সঠিক জবাব বুঝিয়ে দেবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এমন একটি জাতি চাই, যে জাতিতে পাঁচ তলা আর দশ তলার ব্যবধান থাকবে না। কারো দশ তলা থাকুক এতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু, কোন মানুষ অর্থাভাব ও দারিদ্র্যতার কারণে ফুটপাতে থাকবে তা বরদাস্ত করা হবে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে প্রত্যেকটি বঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের জন্য আশ্রয়ানের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আমাদের দেশে কিছুদিন আগে সরকারি উদ্যোগে আশ্রায়ন প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। কোন এক জায়গায় তৈরি করার আগেই ঘর ভেঙ্গে পড়েছিল। জনগণের চোখে ধুলা দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা নেয়ার জন্যই তা করা হয়েছিল।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আমীরে জামায়াত ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে ২০০১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৮ জন, ২০২১ সালে ১৮ জন ও ২০২৪ সালের শহীদদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম বলেন, স্বৈরাচারি হাসিনা সরকার বাংলাদেশকে বৃহত্তর কারাগার বানিয়ে মানুষের সব অধিকার হরন করে নিয়েছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি।তিনি বলেন, ইসলাম হচ্ছে আমাদের জীবনের একমাত্র আদর্শ। আমাদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ জীবনের অংশেই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন আদর্শ মানা যাবে না। আর পূর্নাঙ্গ ইসলাম মানার একমাত্র ক্ষেত্রে হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সেকুলার বা অন্য কোন মানব রচিত আদর্শে গড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় থেকে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম মানা সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, সেকুলারপন্থিরা অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষের মনে ইসলাম ফোবিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছে। জামায়াতের কর্মীদেরকে উন্নত চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার দিয়ে সেই ফোবিয়া দূর করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, কর্মী সম্মেলন শেষে আমীরে জামায়াত ডা: শফিকুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা পরিদর্শন করেন, সেখানে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতী মোবারক উল্লাহসহ উলামা-ছাত্রদের সাথে মতবিনিময় করেন। দুপুরে জেলা জামায়াতের রুকন সম্মেলনে যোগদান শেষে সন্ধ্যায় জামিয়া সিরাজিয়া দারুল উলুম জাদুঘর মাদ্রাসায় পরিদর্শন করেন এবং আলেম-উলামাদের সাথে মতবিনিময় করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জামায়াতের আমীর গোলাম ফারুকের সভাপতিত্বে ও জেলা সেক্রেটারি মুহা. মোবারক হোসাইন আকন্দের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মাসুম,কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ও অধ্যক্ষ কাজী নজরুল ইসলাম খাদেম, অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন,জেলা জামায়াতের সাবেক আমীর সৈয়দ গোলাম সারওয়ার, জেলা নায়েবে আমীর কাজী ইয়াকুব আলী, জামায়াতের ঢাকা মহানগরী উত্তরের প্রচার-মিডিয়া সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার,এডভোকেট আ.বাতেন,সাবেক ছাত্রনেতা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ নাঈম,ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম ভূইয়া প্রমুখ।
আপনার মতামত লিখুন :