ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

অভিজ্ঞ রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিকে অবহেলা করছে সরকার

এফ এ শাহেদ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৪, ০২:৪২ পিএম

অভিজ্ঞ রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিকে অবহেলা করছে সরকার

ছবি সংগৃহীত, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব, ডাকসুর সাবেক ভিপি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। ছিলেন একসময়ের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা ও মানবমুক্তির লড়াইয়ে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের বর্তমান রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ।

রূপালী বাংলাদেশ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বারবার সংলাপে বসছেন, সেটা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে বলে মনে করেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বৈঠক বললেই সবটা বোঝা যায় না। বৈধতার ফাইল ঠিক রাখার জন্য অনেক সময় এ রকম রাজনৈতিক বৈঠক হয়ে থাকে। আনুষ্ঠানিকভাবে পুরো বাম জোটের সঙ্গে মাত্র ৩০ মিনিট ধরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এত কম সময়ে কী আলোচনা হতে পারে? নির্দিষ্ট কিছু বিষয় অবগত করা ছাড়া আন্তরিক কিছু আলোচনার সুযোগ নেই। এটা এই সরকারের একটা প্রেস রিলিজ দিতে পারার বৈধ্যতামাত্র। আমি চাই একটা আন্তরিক মতবিনিময় হোক। আনুষ্ঠানিক করার দরকার কী? অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা আনুষ্ঠানিকই কেন হতে হবে? অনানুষ্ঠানিকও হতে পারে। অনানুষ্ঠানিক ডায়ালগ, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা; সেটা মনে হয় একেবারেই অবহেলা করা হচ্ছে। ভাবটা এমন, যেন সবকিছু আমরাই জানি। তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। বিশেষত আদর্শবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর।  

বামপন্থী হিসেবে আমি দাবি করি, দেশের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে আমাদের গভীরভাবে অধ্যয়ন আছে। আমাদের বিকল্প পরিকল্পনা আছে, সেগুলো তারা যদি অবহিত হয়, তবে তাদের চিন্তার জগৎ প্রসারিত হবে, সিদ্ধান্ত নিতেও সুবিধা হবে। তবে, আমি বলব না যে আমরা যেটা চাই তার সবটা তারা করবে। আমরা চাই সরকার দেশের জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিক এবং নির্বাচনের পরিবেশটা নিশ্চিত করুক। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করুক। তার জন্য সবার প্রজ্ঞা ও জ্ঞান নিয়ে অগ্রসর হতে চাইলে আনুষ্ঠানিক ডায়ালগ করার দরকার কী? অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের সঙ্গে ডায়ালগ হতে পারে।

রূপালী বাংলাদেশ: বর্তমানে তো বিগত সরকারের ১৫ বছরের সিন্ডিকেট নেই, তাহলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে কেন এবং দাম নিয়ন্ত্রণে কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: শুধু রাজনৈতিক সংস্কার করে দেশের সব কাঠামো ঠিক করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক সংস্কারটাও প্রয়োজন। আর তার জন্য প্রয়োজন সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রচলিত, লিবারেল বুর্জয়াব্যবস্থা আমাদের দেশকে সর্বনাশের কিনারে নিয়ে গেছে। এই ব্যবস্থায় লুটপাট অবধারিত। সুতরাং আমরা খালি রাজনৈতিক সংস্কার করব, অর্থনৈতিক সংস্কার করব না, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। ফ্রি মার্কেট ইকোনমিতে সমস্যা বিদ্যমান। অতিতের সরকারগুলো বলেছে, বাজারের কাজ বাজার করবে, ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই। বাজারের কাজ বাজার করবে, এ কথা বলে যদি তাদের দায় এড়াতে চাই, তাহলে সরকারের দরকার হয় না। সবকিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া মানেই তো সেই সালমান রহমানসহ কুখ্যাত লোক, যারা হাজার-লাখ কোটি টাকা লুটপাট করেছে, পাচার করেছে; যার মাধ্যমে তাদের হাতে বন্দী হয়ে যাওয়া। যেটা আমাদের ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দেখলাম। 
সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা। তার জন্য রেশনাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে দ্রব্যমূল্য আনতে হবে। তার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে। সিন্ডিকেট সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিতে হবে। বাজার মনিটরিং চলমান রাখতে হবে, সব ধরনের অসাধু মজুদদার, বিক্রেতার বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

রূপালী বাংলাদেশ: দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকটগুলো সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের এখনই কী ধরনের কাজ আগে করা প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সব কিছুর সুষ্ঠু সমাধানে যেটি প্রথমে প্রয়োজন, সেটা হলো দেশে একটি অবাদ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষে নির্বাচন। যেখানে কোনো টাকার খেলা থাকবে না। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি ঝেটিয়ে বিদায় করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যে সরকার এসেছে, সেটি হলো অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউসূসের নেতৃত্বের সরকার, যার নামের মাধ্যমেই বোঝা যায় এটি একটি বিশেষ সরকার, যেটি নির্বাচিত সরকার নয় আবার কর্তৃত্ববাদী সরকারও নয়।

ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, জনগণের সরাসরি ভোটের দ্বারা সরকার আসার আগ পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী সরকার। এর অর্থ হলো, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগপর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের এই সরকার, যাদের মূল কাজ সমাজের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলোর সৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। অন্যায়ের বিচার করা। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, রাজনীতির চর্চা উন্মুক্ত ও স্বাধীন করে, নির্বাচন ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বাইরে কাজ করার সুযোগ এই সরকারের নেই।

রূপালী বাংলাদেশ: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থান ও দুঃশাসনের বিদায় সমকালীন বিশ্বে এক নজিরবিহীন ঘটনা। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: বৈষম্য-কোটা আন্দোলন থেকে গণআন্দোলনে বাম দলগুলো সরাসরি জড়িত ছিল। আমাদের ছেলেরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, জীবন দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সৈরাচারের পতনের জন্য। বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাম-কমিউনিস্ট দলগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিল। একই সঙ্গে আমাদের দলের সূচনা থেকেই সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছে। ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’ এটা তো আমাদেরই জনপ্রিয় স্লোগান।

এই অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে জীবনের পরোয়া না করে ছাত্র-জনতা যে স্বপ্ন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; তা আমরা ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন শহরের দেওয়ালে যে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে তার মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। খাঁটি-নির্ভেজাল দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান-মর্যাদা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, মানবতা, প্রগতির চিন্তা, সমাজ-দেশ গঠনের স্বপ্নÑ এসব শুভচিন্তাই ফুটে উঠেছে।

রূপালী বাংলাদেশ: আওয়ামী সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই শাসনব্যবস্থা সংস্কার, সংবিধান পুনর্লিখন বা সংস্কারের বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। সংবিধান পুনর্লিখন বা সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে কি?

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: শাসনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে কথা হচ্ছে। তবে সব বিষয় সংস্কার করা এই সরকারের দায়িত্ব নয় বলে আমি মনে করি। যেমন, সংবিধান সংস্কারের কাজ নির্বাচিত সরকারের। এখানে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত প্রয়োজন। জনগণকে পাশ কাটিয়ে এগুলো করা উচিত হবে না। এগুলো আমাদের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়া উচিত।

সংবিধান নতুন করে লেখা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমাদের যে সংবিধান, সেটিকেই সংশোধন করতে হবে এবং মূল সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের কোন কোন ধারা সংশোধন করা যায়, সেগুলো বের কর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। নির্বাচিত সরকার সেগুলো পার্লামেন্টে আলোচনা করে সবার মতামত নিয়ে প্রয়োজন হলে তা বাস্তবায়ন করবে।

আরবি/এস

Link copied!