ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৫

ছোট দলকে ভেড়াতে যে টোপ দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৯, ২০২৫, ০৬:০৬ পিএম

ছোট দলকে ভেড়াতে যে টোপ দিচ্ছে বিএনপি-জামায়াত

ছবি: সংগৃহীত

ভোটের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের অংশ হিসেবে ছোট দলগুলোকে পাশে টানতে চাইছে বিএনপি ও জামায়াত। সন্দেহের ডানা ঝাপটে ইসলামি আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির মহাসচিব। যদিও এর সপ্তাহখানেক আগে জামায়াতে ইসলামির আমির বরিশালে গিয়ে ইসলামি আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। যে বৈঠক রাজনীতিতে সৃষ্টি করে নতুন আলোচনা।

বৈঠকটির পর ইসলামি আন্দোলনের নেতারা ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরির প্রচেষ্টার কথা বলেন। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতের পরে গত সোমবার ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করল বিএনপি। মূলত আওয়ামী লীগ আগামী ভোটে অংশ নিতে পারছে না ধরে নিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী বলয় গড়ার চেষ্টায় মরিয়া দলটির একসময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামির।

ধর্মভিত্তিক দলের জোট এবং অন্যদের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার এ প্রচেষ্টা আটকাতে তৎপর বিএনপিও। যদিও বিএনপির একটি অংশ বলছে, সব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এক হলেও বিএনপির খুব একটা ক্ষতি হবে না, বরং তাতে করে শক্তিশালী বিরোধীদল হতে পারে।

এদিকে জামায়াত যে দলগুলোকে কাছে টানতে চায়, বিএনপিও কাছে টানতে চাচ্ছে সেই দলগুলোকে। তবে শেখ হাসিনার পতন এবং গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্য বিরোধ ও জামায়াতের বন্ধুভাব থাকলেও দু’পক্ষই যোগাযোগ রাখছে বলে জানা গেছে।

মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, আবদুল বাসিত আযাদের খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে জামায়াত এবং ইসলামি আন্দোলন।

অন্য দুই নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দল ইসলামি ঐক্যজোট এবং খেলাফত আন্দোলন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। তাই দল দুটিকে জোটে রাখা হবে না। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সংশ্লিষ্ট অনিবন্ধিত নেজামে ইসলাম গত ১৮ ডিসেম্বর জামায়াত কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেন।

এর আগে আগস্টের বৈঠকে ছিল খেলাফত মজলিসসহ অন্য ধর্মভিত্তিক দল। ছিল না চরমোনাই পীরের দল। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনীতিকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির দিক থেকে এ বৈঠকের লক্ষ্য- দূরত্ব কমিয়ে এনে সম্পর্কোন্নয়ন। তবে এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে মাঠে-ময়দানে বিএনপির সমালোচনা করে দেওয়া দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য থামানো।

বৈঠকে জামায়াতে ইসলামির প্রসঙ্গও এসেছে। নির্বাচনের সময় নিয়ে পুরোপুরি একমত না হলেও ইসলামি শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াসহ ১০টি বিষয়ে একমত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। বৈঠক শেষে বিএনপি ও ইসলামি আন্দোলনের নেতাদের ঘোষণায় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

রাজনৈতিক মহল মনে করছে, নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে জামায়াতের পাল্লা ভারি করার চেষ্টার বিপরীতে বিএনপি এ বৈঠক শুরু করেছে। যদিও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনের আগে অনেকেই প্রলোভন দেখাবে, এটা দেব ওটা দেব বলবে। যেসব ইসলামিক দলের ভোট কম তাদের বিচার বুদ্ধি আছে, আশা করব তারা চিন্তা-ভাবনা করেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। না হয় ভুলের খেশারত দিতে হবে।

রাজনীতিতে ভুল করলে তার মাশুলও দিতে হয়। রাজনীতি যারা করে তারা সেটা জানে। ইসলামি দলগুলো এক হতেই পারে। তবে বেঁচা-কেনা ভালো দেখায় না। আমাদের কানেও এমন খবর আসছে অনেক কিছু দেবে-এমন আশ্বাস দিয়ে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জামায়াত। বাস্তবতা আর খাতা-কলমের হিসাব তো আর এক না। ইসলামিক দলগুলো নিশ্চয়ই তাদের ভালো বুঝবে। সাময়িক আবেগ উত্তেজনায় নিশ্চয়ই ভুল পথে যাবে না তারা।

হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রাব্বানী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের সঙ্গে বিএনপি কিংবা জামায়াতের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। ইসলামিক জোট হবে কি না তাও এখনো নিশ্চিত নয়। তবে একটা জোড় গুঞ্জন রয়েছে- ইসলামি আন্দোলন ও ফেলাফত মজলিম এই নিয়ে কাজ করছে। বিএনপি এবং জামায়াত বৈঠক করছে।

আমরা আসলে অরাজনৈতিক সংগঠন আমরা নির্বাচন করলে অন্য প্ল্যাটফর্ম থেকেই করব। ইসলামি জোট হলে একরকম সিদ্ধান্ত হবে আমাদের, আর না হলে অন্য সিদ্ধান্ত হবে। সেটি এখনই বলা কঠিন। ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ একটি বৈঠক আছে সেখান থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে; তবে তা এখনো নিশ্চিত নয়।

বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোট শীর্ষ নেতা লায়ন মো. ফারুক রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে কোনো রোডম্যাপ না থাকায় জোট নিয়ে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি কারো।

ইসলামি দলগুলো এক হয়ে একজোট কিংবা অ্যালায়েন্স করতে পারে বলে দৌড়ঝাঁপ চলছে। আমরা যারা বিএনপির সঙ্গে এতদিন যুগপৎ আন্দোলন করেছি, আমাদের আশা, বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনে যাব আমরা। তবে আমরা যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছি, তাদের একটি অংশকে প্রলোভন দেখাচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল।

কেউ কেউ সেদিকে যাবে এমন খবর পাচ্ছি। আপনারা জানেন, গত ১৬ বছর আওয়ামীবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকায় আমাদের নিবন্ধন দেয়নি নির্বাচন কমিশন। যাদের নিবন্ধন নেই তারা আসলে কোনো না কোনো জোটে গিয়েই নির্বাচন করব।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে খেলাফত আন্দোলনের এক শীর্ষ নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনের আগে অনেকেই অনেক জোট করে। কেউ কেউ নিজের লাভে অন্য দলকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়। আমাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। সংখ্যানুপাতিক ভোট হলে আমাদের আসন বাড়বে। নিজের লাভ চায় না এমন কেউ আছে নাকি? আমরাও চাইব আমাদের দলকে মূল্যায়ন করবে। যারা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে আমরা তো সেদিকেই যাব না কি? তবে আমাদের বিক্রি করে যাতে কেউ ফায়দা নিতে না পারে সেদিকে আমাদের লক্ষ থাকবে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘সংস্কার ও নির্বাচন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে যে কয়টি রাজনৈতিক দলের মতবিরোধ সামনে আসে, এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামি ও ইসলামি আন্দোলন অন্যতম।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে ‘দখল, চাঁদাবাজি’ নিয়ে জামায়াতের পাশাপাশি বিএনপিকে লক্ষ করে বক্তব্য রেখে আসছিলেন ইসলামি আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম ও জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম।

বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় নিয়েও দল দুটিতে কিছুটা মতপার্থক্য হয়। এ ছাড়া বিএনপি জুলাই-আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে। ইসলামি আন্দোলন প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!