অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতা, দেশে চলমান নানা দাবির পেছনে ষড়যন্ত্র দেখছেন উপদেষ্টারা, তার যৌক্তিকতা, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা, আগামী নির্বাচন ঘিরে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদের যৌক্তিকতা এবং জটিলতা, দখল-চাঁদাবাজি ঘিরে জনগণের মনোভাব, এসব থেকে পরিত্রাণের উপায় কি একমাত্র নির্বাচন এসব নানা বিষয় নিয়ে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ কথা বলেছেন রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ
রূপালী বাংলাদেশ: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যে ভূমিকা, সেখানে জনগণের প্রত্যাশা কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে বলে মনে করছেন?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে বিগত ১৬ বছর জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ জুলাই-আগস্টে অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হয়। ফলে জনগণের দীর্ঘ বছর না-পাওয়ার সব বঞ্চনা হাসিনার পতনের পরে প্রত্যাশার সাগরে পরিণত হয়েছে। এখানে জনগণের এসব প্রত্যাশা পূরণের জন্য রাষ্ট্রের আর্থিক সামর্থ্য, একই সাথে সেবা প্রদানের জন্য যে মানের পেশাদার আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দরকার, সেটা অনুপস্থিত। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদিচ্ছা থাকার পরেও জনগণের প্রত্যশা পূরণ করা বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছে। একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব যেটা ছিল, সেটা কাটিয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশ ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশে নানা ইস্যুতে মুভমেন্ট-অবরোধ চলছে, যার ভেতর ষড়যন্ত্র দেখছেন সরকারের উপদেষ্টারা। এগুলোর যৌক্তিকতা কতখানি দেখেন?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে জনগণের দাবি-দাওয়া, আন্দোলন, প্রতিবাদ, মিছিল-সমাবেশ খুবই সাধারণ একটা বিষয়। যেহেতু দেশে একটি পরিবর্তিত সময় নতুন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সবাই তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উপভোগ করছেন। এখানে সরকার সাপেক্ষে দাবির ন্যায্যতা নিয়ে সব পক্ষের সাথে আলাপ করতে হবে, সমঝোতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধানের রূপকল্প তৈরি করতে হবে। যদি এর মধ্যে ফ্যাসিবাদী জমানার ভূত থাকে, সেটা সুশাসন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে। এতেই সরকারের সক্ষমতা প্রকাশিত হয়।
রূপালী বাংলাদেশ: দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ কতটা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করবে, না জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখেন?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না এটি ভাবতে হবে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদে গুরুত্বপূর্ণ আইন পাসের ক্ষেত্রে দীর্ঘ জটিলতায় পড়তে হয়। আমাদের রাষ্ট্র-কাঠামো পরিগঠনের ইতিহাস, সরকারের আমলাতান্ত্রিক সক্ষমতা, আইন প্রণয়নের জটিলতা সব কিছু মিলিয়ে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ আমাদের জন্য জটিল হয়ে যাবে। আমরা এক কক্ষের সংসদকেই এখনো ক্রিয়াশীল বানাতে পারিনি গত ৫৩ বছরে। বরং একটি সংসদে সংরক্ষিত আসন ১০০-তে উন্নীত করে সব শ্রেণি-পেশার যোগ্য লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার বলে আমরা মনে করি, যা সংখ্যানুপাতিক হারে মনোনীত হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: বৈষম্যমুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিল সাধারণ মানুষ, তা কি পূরণ হচ্ছে?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়ন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় সবাইকে আরও বেশি অবদান রাখতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন একটা লম্বা লড়াই। শত শত বছর ধরে এই সংগ্রাম চালাতে হয়। তাই হুটহাট এই স্বপ্ন পূরণ হয়ে যাবে, সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সবাই মিলেই দেশ গড়ার এই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
রূপালী বাংলাদেশ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশে এখনো খুন, দখল-চাঁদাবাজি চলমান। দুর্বলতা কোথায়?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: গণঅভ্যুত্থানে অগণিত প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিগত ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে। তবে দেশের অর্থনীতি গত হাসিনার লুটেরা সরকার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রায় ৪০টা ব্যাংক লাল জোনে, প্রতিবছর ন্যূনতম ১৬ বিলিয়ন ডলার করে পাচার হয়েছে, যা দিয়ে অতি উচ্চমূল্যের পাঁচটা পদ্মা সেতু করা যেত প্রত্যেক বছর। তার পরেও যে দেশে দুর্ভিক্ষ বা গৃহযুদ্ধ শুরু হয়নি, সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। এ ধরনের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতটা বাজে হতে পারত, তা হয়নি। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করে ধ্বংস করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আওয়ামী রক্ষী বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। লাখ লাখ দলীয় গুণ্ডাদের বাহিনীতে চাকরি দিয়ে তার সক্ষমতা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে আওয়ামী-জাতীয়-১৪ দলীয় ফ্যাসিবাদী কার্টেল। তাই আমরা আশাবাদী, সময়ের ব্যবধানে বাহিনীর সক্ষমতা ফিরে আসবে।
রূপালী বাংলাদেশ: দেশের নাজুক যে অবস্থা এখনো বিদ্যমান, তা থেকে পরিত্রাণের জন্য সংসদ নির্বাচন কি একমাত্র পথ মনে করেন কি না?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: না, আমরা সেটা মনে করি না। সংস্কার, বিচার, নির্বাচন সবই একটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে এটা নয় যে নির্বাচন হলেই দেশ আমেরিকা-সুইজারল্যান্ড হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে, সুশাসন নিশ্চিতের জন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেই শুধু চলবে না। তাদের দেশ পরিচালনার পথনকশা থাকা জরুরি, যা এখনো মোটাদাগে আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
রূপালী বাংলাদেশ: আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পান কি?
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: দেশে বছরের পর বছর গুম-খুনের শিকার হওয়ার পরও দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মালিকানা কারো হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। দেশের মানুষ আওয়ামী লাগের অস্তিত্ব আর কখনো দেখতে চায় না। এমন হতে পারে, তাদের দেখতে হলে জাদুঘরেও যেতে হতে পারে। আওয়ামী লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ দেশের সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই মেনে নেবে না বলে আমরা মনে করি।
রূপালী বাংলাদেশ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ: আপনাকে এবং রূপালী বাংলাদেশকে ধন্যবাদ।
আপনার মতামত লিখুন :