ঢাকা সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

বিএনপি-জামায়াত দ্বন্দ্ব: একসময়ের মিত্র বর্তমান শত্রু কেন?

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৫, ১২:৪৯ পিএম
ফাইল ছবি

নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজনের রেখা। বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। দল দুটির পাল্টাপাল্টি বিবৃতি আর তাদের নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সঙ্গে এক সময়ের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কের টানাপোড়েন কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তবে জুলাই-আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, দুই দলের সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বৃদ্ধি পায়।

বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মতপার্থক্য নিয়ে সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুলে ধরা হয়েছে। যে বিষয়গুলোতে দুই দলের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো:  

  • সংস্কার নাকি নির্বাচন আগে

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার পর, সংস্কারের প্রশ্নে দুই দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে কথা বললেও জামায়াত আগে সংস্কার সম্পন্ন করতে চায়। এমনকি জামায়াতের নির্বাচন বিষয়ে অবস্থানও বিএনপির থেকে ভিন্ন।

  • সংস্কারের প্রশ্নে বিবাদ

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরু থেকেই বিএনপি ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দাবি করে আসছে। তবে জামায়াত বলছে, সার্বিক সংস্কারের পরই নির্বাচন হওয়া উচিত। জামায়াতের মতে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যতটা সময় লাগবে, ততটাই তারা সরকারকে দেবে। আর বিএনপি চাইছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন।

  • স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে বিরোধ

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হতে পারে—এমন খবর বিএনপিকে বিরক্ত করেছে। কারণ তারা জাতীয় নির্বাচন আগে চায়। তবে জামায়াত চায় আগে স্থানীয় নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন।

  • সন্দেহের শুরু কোথায় এবং কেন?

আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি যাতে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী না হতে পারে সে জন্যই জামায়াত নির্বাচন প্রলম্বিত করতে নানা ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা। যদিও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব বা বিরোধিতার কোনো ব্যাপার নেই। বরং বিএনপির মতো তারাও তাদের দলীয় কাজ করে চলেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলছেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার এ বিরোধের মূল কারণ হলো নির্বাচন।

বিএনপি ভাবছে জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী দিচ্ছে বা তারা অন্য ধরনের কিছু করতে পারে। আবার জামায়াত মনে করছে সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সেটি আর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয় কি না। এমন কিছু বিষয়েই দল দুটির চিন্তার ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

এর আগে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্যের জের ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিএনপি নেতারা। গত ২৭ ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে বলে মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান।

সালাউদ্দিন বাবর বলছেন, বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে বিরোধের মূল কেন্দ্রে আছে জাতীয় নির্বাচন অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচন কখন হবে কিংবা কোনটি আগে হবে, জাতীয় নির্বাচন নাকি স্থানীয় নির্বাচন।

  • জামায়াতের বিকল্প জোট গঠনের উদ্যোগ

গত কয়েক মাসে জামায়াত ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে একটি নতুন জোট গঠনের চেষ্টা করেছে, যা বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো, যা বিএনপিকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছে।

  • জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়েও পাল্টাপাল্টি অবস্থান

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে বিএনপির ভূমিকাকে প্রশ্ন করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও তাদের ঘনিষ্ঠ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা যে প্রশ্ন তোলেন, এতে জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন বিএনপির অনেকেই।

বিএনপি দাবি করে, ছাত্রদের আন্দোলনে চূড়ান্তভাবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে তাদের গত ১৫ বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে।

আবার আন্দোলনকারী ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়েও বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার করে ক্ষমতায় থেকে দল গঠনের উদ্যোগের সমালোচনা করেছে।

কিন্তু জামায়াত এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিএনপির অনেকের ধারণা ছাত্রদের এ দল গঠন প্রক্রিয়াকেও উৎসাহিত করছে জামায়াত।

এর মধ্যে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর একটি মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছে জামায়াত এবং এটি দল দুটির মধ্যকার বিরোধের সূত্রপাতের পর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর ঘটনা।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর বাগমারায় এক অনুষ্ঠানে রিজভী বলেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতি উদারতা দেখিয়ে বিএনপি উপহার হিসেবে মুনাফেকি পেয়েছে।

জবাবে জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ এক বিবৃতিতে বলেছেন, তার (রিজভী) এই সব কথার কোনো ভিত্তি নেই। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। জামায়াতের এই ভূমিকা গোটা জাতি গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই সম্ভবত জনাব রিজভীর গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়েছে।

এরপর ২৯ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ৫ আগস্টের পর কি আমরা ব্যাংক আত্মসাৎ করতে দেখিনি? আমরা তো দেখেছি ইসলামী ব্যাংক কীভাবে গ্রাস করে নিলো একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা। তখন রিজভীর বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অফিসিয়াল ফেসবুকে পোস্ট দেয় জামায়াতে ইসলামী। ফটোকার্ড বানিয়ে পোস্টটির জবাবও দেয় বিএনপি।

আবার ডিসেম্বরের শেষদিকেই জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নিজেদের পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে দাবি করার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এখন সবশেষ জামায়াত সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সমর্থন করায় বিএনপির মধ্যে জামায়াত-বিরোধিতা আরও শক্ত আকার ধারণ করেছে।

এরই মধ্যে আগামী নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসনের প্রায় সবগুলোতেই প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। মিয়া গোলাম পরওয়ার অবশ্য সম্প্রতি বলেছেন যে এখন জেলা পর্যায় থেকে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন এলে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রার্থী ঘোষণা করবেন।

সালাউদ্দিন বাবর অবশ্য বলছেন, জামায়াত নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তারা আগে সংস্কার চাইছে কারণ তারা মনে করে নির্বাচনের পর সংস্কার বাস্তবায়ন হলে সেখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাব ফেলতে পারে।

এটিই উভয় দলের মধ্যকার বর্তমান দূরত্বের কারণ বলে মনে করি। ইলেকশন নিয়েই বিভক্তি ও মতপার্থক্য। দ্রুত নির্বাচন জামায়াত চায় না। তারা সরকারকে সংস্কারের জন্য সময় দিতে চাইছে। অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে জামায়াত হয়তো অন্য কিছু করছে যাতে নির্বাচন বিলম্বিত হয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা