ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বর্তমানে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বসহ কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাও পালিয়ে, আত্মগোপনে বা কারাগারে রয়েছেন। ফলে সরকারের পতনের সাত মাস পরও আওয়ামী লীগ দেশে কোনো রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।
৭৫ বছর বয়সী এই দলটি এখন এক চরম সংকটে পড়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যেমন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে, তেমনি দলটির অভ্যন্তরেও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। টানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের ফলে আওয়ামী লীগ রাজনীতি ও জনগণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ক্ষমতার স্বাদ নিতে সুবিধাবাদীদের ভিড় জমেছিল দলটিতে। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার ওপর ভর করেই তারা একতরফা ও বিতর্কিত তিনটি নির্বাচন করেছে।
আওয়ামী লীগ মানুষের ক্ষোভ ও মনোভাবকে গুরুত্ব দেয়নি। তারা নানা সংকট চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের কারণে সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানে তাদের পতন হয়েছে অত্যন্ত করুণ পরিস্থিতিতে। শেখ হাসিনাসহ দলটির শীর্ষ নেতারা বিদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের ভঙ্গুর অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। নেতারা পালিয়েছেন, সুবিধাবাদীরা দল ছেড়েছেন এবং দেশে থাকা নেতা-কর্মীরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। দলের শাসনামলে অর্থপাচার, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তাদের নেতাকর্মীদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করেছে। এছাড়া, গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেককে।
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও, অধিকাংশ দলই তাদের রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার সুযোগ না দেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। ফলে দলের বিকল্প নেতৃত্ব প্রকাশ্যে এসে সংগঠিত করার সাহস দেখাতে পারছে না। বিদেশে থাকা কিছু নেতা সংগঠিত হওয়ার দাবি করলেও, তাদের কার্যক্রম মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক হয়ে পড়েছে, যা দেশের ভেতরে নেতাকর্মীদের মনোবলে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হলেও দলটির দ্বিতীয় স্তরের নেতারা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ছিলেন। যদিও বিভক্তি তৈরি হয়েছিল, তবুও তারা দেশের ভেতরে থেকে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তারা এখনো নিজেদের সংগঠিত করে মাঠে নামতে পারছে না।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা অবশ্য মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতার কারণে তারা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, দলগত অবস্থান দৃশ্যমান না হলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন যমুনার এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে দলটির নতুন নেতৃত্ব কাদের হাতে যায় তার ওপর। একসময় বলা হতো, শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু এখন দলটির ভেতরে ‘আপা’কে বাদ দেওয়ার চিন্তাও করা হতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পরিবর্তনের মানসিকতা এখনো দেখায়নি।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তারা নিষিদ্ধ হয়ে যাক, তাহলে তাদের আর নির্বাচনে অংশ নিতে হবে না এবং বিশ্বব্যাপী তারা সহানুভূতি পাবে। কিন্তু যদি নিষিদ্ধ না হয়, তাহলে দলটিকে জবাবদিহির মুখে পড়তে হবে। আমি মনে করি না, শেখ হাসিনা এখন সেই নৈতিক অবস্থানে আছেন যে, তিনি জেল খেটে দলকে নেতৃত্ব দেবেন। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি ফিরে এসেছিলেন কারণ তখন তার বিপুল জনসমর্থন ছিল। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা একেবারে নেই।’
বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কিছু নেতা দাবি করছেন, তারা দলকে সংগঠিত করছেন। তবে দেশের ভেতরে কর্মসূচি দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো না থাকায় এখনই তারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। দলটির কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী আরাফাতসহ বেশ কয়েকজন নেতা বলছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই তারা দলকে পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না এবং যদি নির্বাচন হয়, তবে তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। তারা আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকদের মতে, দেশের অভ্যন্তরে শক্ত অবস্থান তৈরি না হলে আওয়ামী লীগের জন্য ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে।