গণঅভ্যুত্থানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। জনরোষের ভয়ে দলটির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন বিদেশে। দেশে যারা অবস্থান করছেন তারাও রয়েছেন গা ঢাকা দিয়ে। তবুও পার পাচ্ছেন না অপকর্মে জড়িত হওয়া দলটির নেতাকর্মীরা। হচ্ছেন প্রতিনিয়ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার।
ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় কার্যক্রমে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। মাঝেসাঝে বিদেশ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা ও তা পালনের নির্দেশনা এলেও মাঠে থাকছে না কোনো প্রভাব।
উল্টো নেতা-কর্মীদের অনেকে এখন দলটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অনেকেই আবার নিচ্ছেন দলটির বিরুদ্ধেই অবস্থান। এও খবর আসছে, অনেক সমর্থক ভিড়ছেন বিএনপিসহ সক্রিয় দলগুলোতে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। তারা যেকোনো উপায়ে সমর্থকদের মাঠে নামাতে মরিয়া।
উপায় না পেয়ে এরইমধ্যে কৌশল হিসেবে আন্দোলনরত বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের অধিকার আদায়ের কর্মসূচিতে সমর্থকদের নামাতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে দলটি।
এখন দলটি তাদের মিত্র রাজনৈতিক সংগঠন খুঁজচ্ছে, যে দলগুলো মাঠে নামলে জনরোষের কবলে পড়বে না। এমন দলগুলোর ব্যানারেই মাঠে সক্রিয় হতে চায় আওয়ামী লীগ।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের এখন টার্গেট বামপন্থি দলগুলো। যে দলগুলো ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সমর্থন জুগিয়েছিল।
এরইমধ্যে দীর্ঘদিন পর হঠাৎ সক্রিয় হয়েছেন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লাকী আক্তার। তার আবির্ভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম দিয়েছে ব্যাপক আলোচনা।
অনেকের ধারণা, লাকী প্রকাশ্যে আসার নেপথ্যে আওয়ামী লীগের আশকারা। তাই তাকে ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তারের দাবিতে মিছিলও হয়েছে।
এ নিয়ে যখন নানামুখি আলোচনা, তখন আবার সেই লাকির নেতৃত্বে বেশকিছু বাম সংগঠনের কর্মসূচি আসে শুক্রবার (১৪ মার্চ) রাতে।
সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম, বাংলাদেশ খেতমজুর সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)।
ধর্ষণের শিকার মাগুরার আট বছরের শিশু আছিয়াসহ সব হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের বিচার ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে অপসারণের দাবিতে শনিবার (১৫ মার্চ) সকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে টিএসসি পর্যন্ত গণমিছিলের ডাক দেয়।
ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে জড়ো হয়েছিল। যদিও এতে গণজাগরণ মঞ্চের লাকী আক্তারকে দেখা যায়নি।
তবে ইনকিলাব মঞ্চসহ কয়েকটি সংগঠনের প্রতিবাদী কর্মসূচি ঘিরে ওই গণমিছিল স্থগিত করতে বাধ্য হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের ইন্ধনে এই কর্মসূচি আয়োজন করা হয়েছিল। এতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরাও যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
ওই খবরেই ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন পাল্টা কর্মসূচিতে যায়। ফলে ভেস্তে যায় গণমিছিল কর্মসূচি।
এদিকে বামদের গণমিছিল কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের নির্দেশনার তথ্য রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
গণমিছিলে অংশ নিতে শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গ্রুপে ওই নির্দেশ প্রচার চালিয়েছে দলটি।
এরমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ নামের একটি গ্রুপে ওই কর্মসূচিতে অংশ নিতে দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের আহ্বান করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘সকলকে আহ্বান জানাচ্ছি, কোনো দলীয় স্লোগান নয়, দলীয় ব্যানার নয়, ১৫ই মার্চ ধর্ষণবিরোধী যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, শাহবাগে সেই কর্মসূচিতে, যার যার মতো করে, সবাই অংশগ্রহণ করবেন। এটাই হতে পারে আমাদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জনসমর্থিত দাবি নিয়ে ওই কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল, এতে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অংশ নিত, তা আগেই টের পেয়েছেন তারা। এ কারণে আগে থেকেই শহিদ মিনার এলাকায় নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
পুলিশের একাধিক সূত্রও বলছে, এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্যে ছিল, ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের’।
তবে এই কর্মসূচিকে ঘিরে ‘একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির’ চেষ্টা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা।
গণমিছিল কর্মসূচি ভেস্তে যাওয়ার আগে শহিদ মিনারে রেজা বলেন, ‘আমাদেরকে গতকাল থেকে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বারবার করে ফোন দিয়ে বলা হয়েছে, আমরা যেন এ কর্মসূচি পালন সংক্ষেপ করি এবং পালন না করি। আমরা বলতে চাই, হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না।’
তবে বামদের গণমিছিল কর্মসূচি প্রত্যাহার করলে শাহবাগে গিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, দেশকে অস্থিতিশীল করতে আওয়ামী লীগ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে।’
‘জাতিসংঘের মহাসচিবের সামনে দেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে দেখাতে এই প্রচেষ্টা করছে শাহবাগীরা। আজকে যদি আমরা শাহবাগে অবস্থান না করতাম; তারা আবার শাহবাগ দখল করে আরেকটা শাহবাগ করতো’, বলেন হাদি।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। যার মধ্যে দিয়ে টানা ১৬ বছরের ক্ষমতার পতন ঘটে। এরপর শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
শেখ হাসিনার মতো অনেক নেতাই বিদেশে পালিয়ে যান। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তাদের বিচার কার্যক্রম চলমান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে থাকা দলের অন্য নেতাদের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অনেক মামলা হয়েছে এবং বিচারের কার্যক্রম চলমান।
তবে পালিয়ে যাওয়া নেতারা বিদেশে থেকেই দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মাঠে নামানোর জন্য নানা পরিকল্পনা করছে। খুঁজছে সুযোগ।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয়কে নস্যাৎ করে দিতে আওয়ামী লীগ দিল্লি বসে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করে আসছে বিএনপি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ওই আওয়ামী লীগ আজকে দিল্লিতে বসে ষড়যন্ত্র করছে বাংলাদেশের বিজয়কে ভণ্ডুল করে দিতে। স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশের জনগণের যে শত্রু, যাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে, তাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত জনগণের ভালোবাসা পেতে পারে বলে আমি মনে করি না।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি এক কর্মীসভায় বলেন, ‘কেউ কেই প্রশ্ন করেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ফিরবে কি না, কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আর ফিরে আসার সুযোগ নাই।’
জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি বলেন, ‘বাংলাদেশে আর আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট রাজনীতির জায়গা হবে না। আমরা মনে করি, ৫ আগস্টেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ রায় দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও অভিযোগ করে আসছেন যে, আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
সম্প্রতি এক জরুরি সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবে হোক এটা প্রতিহত করা হবে।’