ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে চলছে টানাপোড়েন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে আওয়ামী লীগ নিয়ে দুটি বিকল্প ভাবনার কথা জানা গেছে। একটি পক্ষ চায়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সবাইকে বাদ দিয়ে ‘রেভেল’ তথা বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ গঠন করানো। আরেকটি বিকল্প হলো, শেখ হাসিনার সম্মতিতে তাঁর পরিবর্তে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নেতৃত্বে ‘রিফাইন্ড’ তথা পরিশোধিত আওয়ামী লীগকে ভোটে রাখা।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছে। এ চাওয়া পূরণে ‘শেখ হাসিনাবিরোধী নেতাদের আওয়ামী লীগ’কে নির্বাচনে সুযোগ দেওয়া যায় কি না- এ ভাবনা রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশের মধ্যে। তবে এ সুযোগ পেতে ‘হাসিনাবিরোধী’ নেতাদের জুলাই গণহত্যা, তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন, গুম-খুন, ব্যাংক লুট, টাকা পাচারের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে ‘রিকনসিলিয়েশন’ বলতে চাচ্ছেন কেউ কেউ। একজন উপদেষ্টাসহ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের কয়েকজনের এতে সায় ছিল। গত ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের ফেসবুক পোস্টে গত তিন দিনে আওয়ামী লীগ নিয়ে দ্বিতীয় বিকল্প ভাবনাটি সামনে আসে। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নিয়ে নতুন আওয়ামী লীগ গঠনের চিন্তাকে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ বলছেন ছাত্রনেতারা। তাদের বড় অংশই জুলাই গণহত্যার দায়ে বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধী। এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে মাঠেও নেমেছে।
গত বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে হাসনাত আবদুল্লাহ দাবি করেন, তিনিসহ আরও দুই জনের কাছে ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, তারা যেন আসন সমঝোতার বিনিময়ে প্রস্তাব মেনে নেন। তবে এর আগে থেকেই আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন নিয়ে সরব ছিলেন হাসনাত।
গত ১২ মার্চ তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছে। ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ‘ট্যাবলেট’ নিয়ে শিগগিরই হাজির হবে।
গত ১৫ মার্চ লেখেন, যে পথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়েছে, ঠিক সে পথ দিয়েই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
২০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্বোধন করে লেখেন, ড. ইউনূস, আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।
অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানান, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা নেই সরকারের। এ বক্তব্যের পর মধ্যরাতে হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা চলছে। তিনি দাবি করেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে এ প্রস্তাব এসেছে।
রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে ১ম বারের মতো এ আলাপ দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি করে। পরদিন শুক্রবার এনসিপি সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানায়।
তবে পরদিন দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, হাসনাতের লেখা শিষ্টাচারবহির্ভূত।
রোববার (২৩ মার্চ) সারজিস আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, ১১ মার্চ ছাত্রনেতাদের আগ্রহেই সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। জেনারেল ওয়াকার আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেননি, বরং নিজের অভিমত জানান। হাসনাত যে কথোপকথনের কথা লেখেন, তা সত্য জানিয়ে সারজিস বলেছেন, সেনাপ্রধান ক্ষুব্ধ নয়। জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা যেভাবে বলেন সেভাবেই বলেছিলেন।
তবে সারজিসও বলেছেন, জুলাই গণহত্যা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটানো আওয়ামী লীগের যেকোনো ভার্সনের রাজনীতিতে আসার বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, গত ৩ অক্টোবর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়ার পক্ষে তারা নন।
অন্যদিকে, গত শনিবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন রেখেছিলেন, যারা ছাত্র হত্যা করেনি, যারা অর্থ লোপাট করেনি; সৎ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, তারা নেতৃত্বে এলে আওয়ামী লীগ কেন রাজনীতি করতে পারবে না?
তবে হাসনাতের স্ট্যাটাসের পর শুরু হওয়া আলোচনার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত শনিবার বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন হয় এমন কিছু করা যাবে না।
পরদিন রুহুল কবির রিজভীও বলেন, ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন চায় না বিএনপি।
তবে দলীয় সূত্রগুলো জানায়, শেখ হাসিনা এবং যাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে, তাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এলে আপত্তি নেই বিএনপির। দ্রুত নির্বাচন চাওয়া দলটির নেতারা আওয়ামী লীগ বিতর্ককে সন্দেহের চোখে দেখছেন। তারা একে নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করছেন। সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন চান। তাই যারা নির্বাচন চায় না, তারা ওয়াকার-উজ-জামানকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি করছে।
অবশ্য বিএনপি নেতাদের কেউ ‘সেনাবাহিনী-এনসিপি-আওয়ামী লীগ’ বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দায়িত্ব বিএনপি নেয়নি। বিএনপি ১৭ বছর রাজপথে ছিল। নিজেদের পুনর্বাসনই এখন বিএনপির কাজ।
হাসনাত-সারজিসদের যে বৈঠক নিয়ে আলোচনা চলছে, তেমন বৈঠক আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পৃথকভাবে হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তেমন একটি বৈঠকে অংশ নেওয়া একজন নেতা বলেন, বড় দলগুলোর আওয়ামী লীগের ‘পরিশুদ্ধ ভার্সন’ বিষয়ে অভিমত জানতে চাওয়া হয়।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, কোনোরূপেই আওয়ামী লীগকে ভোটের রাজনীতিতে ফেরানো কারও দায়িত্ব নয়। আগে জুলাই গণহত্যা, ১৫ বছরের গুম-খুনের বিচার হোক। পরে আওয়ামী লীগ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা যাবে।
অভ্যুত্থানের পর হত্যা মামলায় দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের একাংশ কারাগারে, বাকিরা পলাতক। জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান অনুযায়ী, হত্যাযজ্ঞে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগী ছিল আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলো।
সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান বলেন, সরকারের চিন্তা হলো, যারা শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের পরিত্যাগ করে ১৫ বছরের সব অপকর্মের জন্য দায় উন্মোচন করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাচনে আসতে চান, তাদের আসতে দেওয়া হবে। অতীতে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন, সরকারের এমন একজন উপদেষ্টাকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, এর সমান্তরালে আরেকটি প্রচেষ্টা চলছে, তা শেখ হাসিনার বদলে অন্য কাউকে দলের দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনা। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীকে এ দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা আছে। তবে তিনি ‘বিদ্রোহী’ হতে রাজি নন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে শুধু সাবের হোসেন চৌধুরী এবং সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জামিন পেয়েছেন। রিমান্ড চলাকালে সাবের হোসেন এক দিনে ৬ মামলায় জামিন পাওয়ায় গত অক্টোবর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিতে পারেন।
তার সঙ্গে কথা বলা একজন রাজনীতিক জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা অনুমোদন দিলে এটা হতে পারে। আর সরকারকে দিতে হবে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। তবে এ বিষয়ে সাবের হোসেনের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, শেখ হাসিনা ঐক্যের প্রতীক; নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই আসে না।
একাধিক রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, পরিশোধিত আওয়ামী লীগ হতে হবে হাসিনার অনুমোদনে। সময় ও পরিবেশ অনুকূলে এলে ‘পরিশোধিত’ আওয়ামী লীগে ফিরতে পারেন হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাই এতে রাজি নয় সরকার, ছাত্রনেতা এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।
তাদের মূল্যায়ন, বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ গঠিত হলে তা হবে দলটির স্থায়ী বিভক্তি। বিদ্রোহী অংশ মূল দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও, কখনোই শেখ হাসিনার সমর্থকদের সমর্থন পাবে না। ফলে এই দল অন্যদের জন্য তেমন হুমকি হতে পারবে না। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে বর্ণবাদী শাসনের সময়ের অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, একই পদ্ধতিতে বিচার ও অনুশোচনার পর এই আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিতে রাজি তারা।