বাংলাদেশে এবারের ঈদুল ফিতর পালিত হচ্ছে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায়। বিএনপি, জামায়াতের মত পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। পিছিয়ে নেই সদ্য গঠিত দল এনসিপিও।
তবে, এবার মাঠে কোনো `সরকারি দল` নেই।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি তৃণমুলের অনেক নেতাকর্মীও আত্মগোপনে কিংবা এলাকা থেকে দূরে রয়েছেন।
এদিকে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সময় যতই গড়িয়েছে, অভ্যুত্থানের পক্ষগুলোর মধ্যে ততই বিভিন্ন ইস্যুতে মতভেদ স্পষ্ট হচ্ছে।
মতভেদ এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টিগুলোতে বিভিন্ন দলের নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে দেখা গেছে।
অবশ্য, পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে দেখা গেলেও বেশ কয়েক বছর পরে এবারই আবার একে অন্যকে ইফতার আয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের নেতারা এবং তারা নিজেরাও অংশও নিয়েছেন অন্য দলের ইফতারে।
এখন ঈদের পর দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন এবং সংস্কার ইস্যুতে দলগুলোর মতভেদ বড় আকারে সামনে চলে আসতে পারে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
দলভেদে কোনো কর্মসূচি আসবে কি না, তা নিয়েও রাজনীতির অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে।
ঈদের সময়টা কাজে লাগাতে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার মত করে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন বড় দলগুলোর নেতাকর্মীরা।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে সেভাবেই তৎপর থাকতে বলা হয়েছে তৃণমূল কর্মীদের। সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহের রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় দেশে আগামী নির্বাচনের দিন-তারিখ কবে ঘোষণা হবে। রোজার মধ্যে নানাভাবে নিজেদের উপস্থিতি জারি রাখার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি জোর দিয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং জুলাই আগস্টে নিপীড়নের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারে দাবিতে। অগ্রাধিকারের দিক থেকে এগুলোর পরে নির্বাচনকে রেখেছে তারা।
অন্যদিকে, বিএনপি`র কর্মসূচিগুলোতে দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়েছে বার বার।
সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, "নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে।"
রাজনৈতিক দলগুলো `নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে` বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু, তার এ বক্তব্যে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি হতাশা প্রকাশ করে।
গত ডিসেম্বর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে `ধোঁয়াশা` ও `অস্পষ্টতার` অভিযোগ তুলে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছে দলটি।
এবার এ দাবিতে তারা আরো সক্রিয় হতে চায়। আরো একবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাগাদা দিতে চায় সরকারকে।
ঈদের পর প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করে বিএনপি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান জানাবে, বলছেন দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমদ।
নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে `অস্পষ্টতা`কে বিএনপি দেখছে সন্দেহ ও সংশয় নিয়ে। নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না করার পেছনে কারণ কী, সেটি বুঝতে চায় তারা।
অন্যদিকে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের আরেক অংশীদার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছে।
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্যে পূর্ণ আস্থা রাখছে তার দল।
আর, রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকতে চায় গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি - এনসিপি।
বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলছেন, সার্বিক পরিস্থিতি থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, বিএনপি`র প্রত্যাশা মত ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ফলে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে বিএনপি মাঠে থাকতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি অস্থিতিশীলতার দিকে গড়ায় এমন কোনো কর্মসূচির দিকে হয়ত তারা যেতে চাইবে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক ভাষণে `চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে` নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথায় তারা হতাশ হয়েছেন।
তিনি বলেন, নির্বাচনটা যে চাচ্ছি, সেটা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়, আমরা মনে করি নির্বাচন হলে জনগণের ম্যান্ডেট পাবে সেই সরকার। সেই সরকারের শক্তি আর একটা অনির্বাচিত সরকারের শক্তির মধ্যে পার্থক্য আছে।
এদিকে, বিএনপি`র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য এতোদিন ধরে তারা সরকারের কাছে যে আহ্বান জানিয়ে আসছেন, ঈদের পর তা আরেকবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে চান।
তিনি বলেন, ফরমালি হয়তো প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করে আহ্বান জানাবো। উনি কী পদক্ষেপ নেন এবং কী ঘোষণা দেন, সেটার জন্য কিছু সময় অপেক্ষা করবো আমরা।
এরপরও প্রত্যাশিত ঘোষণা না এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরতে চান তারা।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি একেক সময় একেক কথা বলেন, দেখতে হবে উনি কেন এভাবে বলছেন? আমরা আগে ওনার সাথে কথা বলে নেবো। তার প্রেক্ষিতে উনি কী করেন সেটা দেখবো। তারপর আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্য মাঠে-ময়দানে, জনগণের কাছে কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তুলে ধরবো।
বিএনপি কর্মসূচি নিয়ে নামলে তাদের একসময়ের জোটসঙ্গী এবং বর্তমানে অন্তত বক্তব্য-বিবৃতির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হওয়া ইসলামী কী করবে?
এমন প্রশ্নে দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এমন না যে সরকার কিছুই বলেনি। সরকার তো একটা আইডিয়া দিয়েছে। সরকার গ্রহণযোগ্য যতটুকু সময় চাচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ততটুকু সময় দেয়ার পক্ষে। ছয় মাস আগে কী পরে - এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ন্যূনতম সংস্কার ছাড়া তাড়াহুড়ো করে নির্বাচন করে চৌদ্দ-আঠারোর মত নির্বাচন হলে লাভ কী? তাই, সময়কে শর্ত না বানিয়ে আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচনকে শর্ত বানিয়েছি।
সংস্কার ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিবের এমন মন্তব্যের উল্লেখ করে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, একদিকে বলবো সংস্কার চাই, অন্যদিকে বলবো সংস্কার ও নির্বাচন একসাথে হয়। হয় না। তাহলে পেছনের ১৫ বছরের কালো জীবন আমাদের ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, তারা (জামায়াত) আপাতত মাঠে নামার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না।
তিনি আরও বলেন, অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনের সময়ের জন্য আন্দোলনে নামে, তারা কী বলে সেটা দেখে তখন আমাদের দলের বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
আগামীতে সরকারকে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতা ও নির্বাচনমুখী রাজনীতি করার কথা বলেন জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের এই নেতা।
জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপিও তাদের দাবি ও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে চায়।
নতুন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আমরা জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সংস্কারের প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা হাজির করবো।
তিনি বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে রাষ্ট্রের সামগ্রিক সংস্কারে সরকারের উদ্যোগকে দৃশ্যমান করা, গণহত্যার অপরাধে আওয়ামী লীগের বিচার কার্যক্রমকে গতিশীল করা ও গণপরিষদ নির্বাচনের দিকে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে আমরা রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো।
বিএনপি এবং এনসিপি ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকার নিয়ে মাঠে থাকলে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াতে পারে কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা মনে করি পূর্বের মতো হানাহানি-মারামারির যে রাজনীতি ছিল, তার বাইরে এসে পলিসি নির্ধারণের যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দলগুলোকে সেইদিকেই এগোনো উচিত।
ক্রমশ বৈরিতার পথে হাঁটা দলগুলোর অবস্থান আগামীতে তৃণমূলের রাজনীতিতে কিছুটা উত্তেজনা ছড়াতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
তিনি বলেন, বিশেষ করে এই ধারণা ছড়াতে পারে যে, সরকার এনসিপিকে আরেকটু স্ট্রং ফুটিং (পরিধি বাড়ানোর) এর সুযোগ করে দিচ্ছে।
অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, আর যদি সরকারের গুড ইনটেনশন (ভালো মনোভাব) আমলে নেওয়া হয়, অর্থাৎ যথার্থ অর্থেই তারা কিছু রিফর্ম করতে চাচ্ছেন - তাহলেও নির্বাচন ডিসেম্বর নাগাদ করা কঠিন। কারণ, ন্যূনতম সংস্কার এবং ঐকমত্যে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ উতরানো সহজ হবে না।
ফলে বিএনপি একটা চাপ ধরে রাখতে চাইবেই, বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে, জামায়াতের ভোটের সংখ্যা বা জনসমর্থনে নির্বাচনের সময়সীমা বিশেষ ফারাক তৈরি করবে না, তাই তাদের উদ্বেগের কিছু নেই, ব্যাখ্যা করেন অধ্যাপক আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, সময় গড়ালে এনসিপি দলের শক্তি বাড়ানোর সুযোগ পাবে, ফলে তাদের অবস্থান নির্বাচন পেছানোর পক্ষে থাকা স্বাভাবিক।
তবে তার মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় কিংবা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন অবস্থানে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা