ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বাঁক বদলের তিন বড় গণঅভ্যুত্থানেই বিএনপির লাভ

রূপালী ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪, ০৫:৩৯ পিএম

বাঁক বদলের তিন বড় গণঅভ্যুত্থানেই বিএনপির লাভ

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম দল বিএনপি। যার ইতিহাস ঘাটতে গেলে বের হয়ে আসে নানা আন্দোলন-অভ্যুত্থান। শুধু তাই নয়, দেশের রাজনীতিতে বাঁক বদলের বড় তিন গণঅভ্যুত্থানেই দৃশ্যত লাভবান হয়েছে দলটি।

১৯৭৫ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পরে বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। আর ২০২৪ সালে এসে গণঅভুত্থানের মাধ্যমে আবারও দলটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিটি গণঅভ্যুত্থানেই রাজনৈতিক শূন্যতা এবং আওয়ামী লীগের নেতিবাচকতার সুবিধা পেয়েছে বিএনপি।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার বলছেন, ‘পূর্বের দুটো গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক শূন্যতার সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগও বিএনপি পেয়েছে।’

এছাড়া রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।’

বিএনপি যে তিনটি গণঅভ্যুত্থানে লাভবান হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে-

* ১৯৭৫ সালের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেকের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিববিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর তৎকালীন বাংলাদেশে পরিষ্কার রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সেটি পূরণ করার জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোনো দল ছিল না। যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের জনভিত্তি ততটা শক্ত ছিল না।

হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে বিএনপি নামক কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ছিল না। তখন ক্ষমতায় এসেছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন। তবে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের বাইরেও অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিববিরোধীরা। ভারতীয় চক্রান্তের গুজব ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে দুঃশ্চিন্তা এবং সন্দেহ দেখা দেয়। ৭ নভেম্বর দেশের বিভিন্ন সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছায় এবং তাদের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার জনতা যোগ দেয়।

এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলছেন, তখন অনেকের ধারণা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ হয়তো ভারতের সহায়তা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। সেই আশঙ্কা কিংবা প্রেক্ষাপট থেকে ৭ নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।

বন্দীদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, ৭ নভেম্বর বিদ্রোহ না হলে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে কতটা আসতেন কিংবা আসলেও কতটা সফল হতেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

৭ নভেম্বরের পর থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালিত হতে জিয়াউর রহমানের ইশারায়। কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। যে জিয়াউর রহমানকে পাশে পাবার আশায় ছিলেন কর্নেল তাহের, সে জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে ভিন্ন ইঙ্গিত দিলেন।

দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ক্ষমতা পরিচালিত হতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায়।

১৯৭৬ সালে জুলাই মাসে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। বিচারের কয়েকদিন পরেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।

১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে সরে যান আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পাঁচ মাসের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে দিয়ে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান।

মহিউদ্দিন আহমদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘সময়টাকে বিএনপি তাদের পক্ষে নিতে পেরেছিল, আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিজের পক্ষে নিতে পেরেছিলেন।’

* ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান

১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল। কিন্তু দেখা গেল, এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। তখন এরশাদবিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

নির্বাচনে অংশ নেবার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সঙ্গে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন।

মওদুদ আহমদের লেখা ‘চলমান ইতিহাস, জীবনের কিছু সময় কিছু কথা ১৯৮৩-১৯৯০’ বইতে এ বিষয়টি উঠে এসছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের সাথে এক গভীর সমঝোতার পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তারা তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।’

আমেরিকান পাবলিক ইউনিভার্সিটি সিস্টেমের শিক্ষক সাঈদ ইফতেখার আহমেদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, বিএনপি তখন একটা ধারণা তৈরি করতে পেরেছিল যে আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ না নিত তাহলে এরশাদের পতন আরও আগেই ঘটানো সম্ভব হতো।

তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি বিএনপিকে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছিল এরশাদের পতনের পর। এর ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে নেতা হন নাই। জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি দলে এসেছিলেন, কিন্তু নেতা হয়েছিলেন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ফসলটা তিনি ঘরে তুলেছিলেন ১৯৯১ সালে।’

* ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।

শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে পালিয়ে বেড়ানো কিংবা মামলায় জর্জরিত থাকা বিএনপি নেতারা এখন আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

৫ আগস্টের পরে বেশ দ্রুততার সাথে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করের রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকের বিরুদ্ধে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।

লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে।

মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষণিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।

গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেওয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতিবাচক হিসেবে উপস্থিতি হয়েছে জনগণের সামনে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষ আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বরাবর বিএনপিকেই দেখেছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে কোনো ফারাক নেই। তাদের মধ্যে অমিল আছে, আবার অনেক মিলও আছে।’ তবে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন কোন শক্তি আবির্ভূত হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে সেটি এখনই বলা মুশকিল।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরবি/এফআই

Link copied!