ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

ম্যাজিক আতিকের হাজার কোটি টাকা লুটপাট

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৪, ০৪:০০ পিএম

ম্যাজিক আতিকের হাজার কোটি টাকা লুটপাট

ছবি: মো.আতিকুল ইসলাম

ঢাকা: উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো.আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট ও পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আতিক যে সময় মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন তখন নিজের বা স্ত্রী-সন্তানদের সম্পত্তির তালিকায় নিজস্ব কোন গাড়ি উল্লেখ ছিল না। ১৬টি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েও তখন তার সম্পত্তির হিসাব ছিল মাত্র ৮৭ হাজার ৬৩ টাকা।

ডিএনসিসি’র সূত্র জানায়, সাবেক মেয়র আতিককে যিনি ম্যাজিক আতিক নামেই সুপপরিচিত ছিলেন তার কাজের মাধ্যমে। যিনি ম্যাজিক দেখিয়ে হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার ও লুটপাট করেছেন। যার কাছে যে কোনো ধরনের কাজ নিয়ে গেলেই টাকার বিনময়ে তিনি ম্যাজিকের মতো কাজ করে দিতেন। এজন্য তাকে ম্যাজিক মেয়র বলতেন সবাই।

সূত্রের তথ্যমতে, মেয়র আতিক যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর সহ নানা দেশে অঢেল সম্পদ পড়েছেন। তবে, কানাডা, দুবাই, মালয়েশিয়া, ও সিঙ্গাপুরে বেশি অর্থ পাচার করেছে ম্যাজিক কাকা। সেই তুলনায় দেশে তেমন কিছুই করেননি, ম্যাজিক দেখিয়েছেন দেশের বাইরে।

সাবেক মেয়র আতিকের কাছের এক ব্যক্তি জানান, বিদেশে মেয়র আতিকের বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট রয়েছে। তিনি নামে বেনামে সেসব সম্পদ গড়েছেন। বিদেশি প্রজেক্ট তার মেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ‘চিফ হিট অফিসা‘ বুশরা আফরিন দেখাশোনা করেন। এভাবেই তিনি মেয়রের আড়ালে কুকৃতির ম্যাজিক দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

এসকল তথ্য ক্রমেই জানাজানি হচ্ছে। তবে, ম্যাজিক আতিকের আসল তথ্য জানতে তাকে গ্রেপ্তারের আইনেও আওতায় নেয়ার মধ্যমে পাচারসহ অপকর্মের সকল তথ্য জানতে চায় সাধারণ মানুষ। একইসাথে দুদকের মাধ্যমে সম্পদের সুষ্ট তথ্য পেতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জিজ্ঞাসাবাদের দাবি করেন।

সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো.আতিকুল ইসলাম ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কয়েক এক হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাটের অভিযোগ আছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত কাছের ও আস্থাভাজন ছিলেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। আর সে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে লুটপাট সহ পাচারে যুক্ত ছিলেন ম্যাজিক আতিক।

যে সব নৈরাজ্য করেছে সাবেক মেয়র আতিক
অতিমাত্রায় তেলবাজ, চাটুকার, দুর্নীতিবাজ ও লোপাটকারী আলোচনা রয়েছেন ডিএনসিসির সাবেক মেয়র. আতিকুল ইসলাম। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার সাথে সাথে এলজিআরডি মন্ত্রীসহ অনেকেই পালিয়ে রয়েছে। তবে তাদের একদিন আগেই গত ৪ আগস্ট পালিয়ে যান ডিএনসিসির মেয়র. আতিকুল ইসলাম।  বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, বাংলাদেশে না বিদেশে পালিয়েছেন? ডিএনসিসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এসব বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না। আতিক না থাকায়- ডিএনসিসির দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টার আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন মনে করেন সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। মেয়র আতিক দেশ বিদেশে শত শত কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করেছে। তার নামে ভারতে একটি কোম্পানি রয়েছে বলে দাবি করেন তারা।

নাম না প্রকাশ করতে শর্তে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বলেছে, সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা, জনগণের ট্যাক্সের টাকা এবং সরকারের দান অনুদানের কয়েক হাজার কোটি টাকা পচার ও লোপাটের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন সদ্য আত্মগোপনে যাওয়া মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও তার সগযোগিরা।

তথ্য মতে, তিনি ডিএনসিসিকে দুর্নীতির আখঁড়ায় পরিনত করেন। টানা চার বছর প্রকাশ্যে  নানা অনিয়ম,দুর্নীতি, খোঁড়া অজুহাতে সাজানো প্রকল্প, অপ্রয়জনীয় বেশ কিছু অনুষ্ঠান ও শোডাউনের মাধ্যমে মেয়রের ভাগনে-তৌফিক,ভাতিজা ইমরান, এপিএস- ফরিদ, এপিএস মোরশেদ, বিভিন্ন বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা ও সচিবের দপ্তরের সহযোগিতায় অনেক ভুয়া বিল ভাউচারে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।  সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ডিএনসিসিকে আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনৈতিক এবং মেয়রের নিজস্ব বাণিজ্যিক কার্যালয় বানিয়ে ছিলেন। আতিকুল ইসলাম মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পরই নগরবাসী এবং ডিএনসিসির সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ধারণা ছিল এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি ও লোপাট মুক্ত থাকবে। কিন্তু  তিনি দ্রুততম  সময়ের মধ্যে ডিএনসিসিকে দুর্নীতির আঁখড়ায় পরিনত করেছেন। মেয়র দপ্তরকে একটি আতঙ্কিত সিন্ডিকেট দপ্তরে পরিনত করেছেন। অনেক বিভাগীয় প্রধান, উপ প্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক পদমর্যাদার কর্মকর্তা প্রথমে মেয়রের দপ্তরের সৃষ্ট সিন্ডিকেটকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে মেয়রের পক্ষ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মৌখিকভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, চাকরি করতে হলে, তাদের নির্দেশনা মানতে হবে। অন্যথায় শুধু মাত্র ৩ মাসের বেতন ভাতা নিয়েই বিদায় হতে হবে।

এরপরেও বেশ কয়জন কর্মকর্তা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছন, মেয়রের সামনে জোরালো অবস্থান বজায় রেখেছেন এবং প্রতিবাদ করেছেন। আর এসব ঘটনায় সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলামকে তাৎক্ষনিক বিদায় নিতে হয়েছে। এছাড়া ভুয়া বিল ভাউচারে স্বাক্ষর করতে রাজি না হওয়ায় অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. তাজুল ইসলামকে হয়রানী হরা হয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাকের ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। আবুল বাশার অনেক চেষ্টার পরে চট্টগামের বদলি স্থগিত করে ঢাকায় শিল্পমন্ত্রণালয়ে পোস্টিং নেয়। কিন্তু তাকে টানা ৩/৪ মাস ছাড়পত্র না দিয়ে আটকে রেখে ছিলেন বলে অভিযোগ উঠে। পরে ভীতিকর এই পরিস্থিতে ডিএনসিসির এক শ্রেনির কর্মকর্তা ক্ষমতা ও অর্থলোভে মেয়র দপ্তরের সৃষ্ট সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হয়। এর চক্রটি ডিএনসিসির শত শত কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্পে এবং কেনা কাটার নামে দাপটের সাথে লোপাট ও পাচার করতে থাকে। এভাবেই ধংস হয় উত্তর সিটি।

অর্থ লোপাটের ধরণ
মেয়র আতিক মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন উদ্বোধন উপলক্ষে সমাবেশের আয়োজনের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকার  খরচ দেখিয়ে ৫ কোটি টাকা লোপাট করেন। এছাড়া নগরীতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের নামে নিজের মেয়ে ‘বুশরা’কে প্রধান হিট অফিসার নিয়োগ করে তার পিছনে কোটি কোটি টাকা ব্যায় হয়েছে বলে সরকারকে দেখান।

নগরীর বিভিন্ন আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগান আর নগরবাসী ধোকা দেওয়ার জন্য প্রধান প্রদান সড়কে গাড়ি থেকে উপরের দিকে পানি ছিটানোকে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো গল্প বানিয়েছেন। গরমে সড়কে গাড়ি থেকে পানি ছিটানোর নামে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচারে এসব আত্মসাৎ করেন। এখানেই শেষ নয় ডিএনসিসির প্রধান হিট অফিসার ‘বুশরা’কে দিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শোডাউন ও অনুষ্ঠানের নামে প্রায় কোটি টাকার খরচ দেখিয়ে সিংহভাগ অর্থ আত্মসাৎ করেছন। নগরীতে গাছ লাগানোর নামে কয়েক কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ আছে।

আতিক ডিএনসিসির ডিজিটাল সার্বভার ওয়েভসাইট তৈরির নামে ১৫ কোটি টাকার বেশি খরচ দেখান। আউট সোসিংএ ৫ শতাধিক লোক ৪টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ’মাল্টি ইন্টারন্যাশনাল, ক্লিনটেক, রাকিব এন্টারপ্রাইজ ও খন্দাকার কোম্পানি’মাধ্যমে নিয়োগ করে আরো বড় ধরনের দুর্নীতি ও লোপাট করতেন। এভাবেই উত্তর সিটিকে সুকৌশলে খেয়ে ফেলছে মেয়র আতিক।

আতিকের নামে মামলা
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগেই হাজার কোটি টাকার পাচার ও লোপাট করে পালিয়ে যান মেয়র আতিক। সূত্র জানায়, আতিকের নামে প্রায় শতাধিক মামলা আছে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ পদত্যাগের পর গেল মঙ্গলবার ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে  মো. আব্দুর রহিম নামে এক ব্যক্তি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৫/২৯ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন।

সূত্র জানায়, রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে ভাসানটেক পুনর্বাসন ও বিজয় সরণির কলমিলতা বাজার প্রকল্প থেকে যে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এজন্য তার নামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদেরের মেয়ে নুরতাজ আরা ঐশী একটি মামলাও দায়ের করেছেন।

উল্লেখ্য, আতিকুল ইসলাম একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র। তিনি ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ৭ মার্চ মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। আতিকুল ইসলাম (জন্ম ১ জুলাই ১৯৬১) সে একজন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী পদমর্যাদায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-নির্বাচনে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। এবং ৭ মার্চ মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন। এরপূর্বে তিনি ২০১৩-১৪ সাল মেয়াদে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় থেকেই মেয়র আতিক ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্থ।
 

আরবি/এস

Link copied!