ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

মির্জা হাসান মাহমুদ

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ০২:১৬ পিএম

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

ছবি: ইন্টারনেট

একটি গ্রামীণ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ়া চুপচাপ অপেক্ষা করছেন। তার চোখের কোণায় দুশ্চিন্তার ছায়া, কিন্তু মুখে একটা প্রশান্তি। অপেক্ষার এই সময়ে তিনি ভাবছেন তার সন্তানের কথা;যে হাজার মাইল দূরে, বিদেশের মাটিতে কাজ করছে, ঘাম ঝরাচ্ছে। সেই সন্তান প্রতি মাসে তার কঠোর পরিশ্রমের অর্থ পাঠায় মায়ের কাছে; যা দিয়ে মায়ের সংসার চলে, সংসারের সব দায়িত্ব পালন হয়। কিন্তু এই অর্থ শুধু একটি পরিবারের জীবনকে বদলায় না, বদলে দেয় পুরো একটি দেশের অর্থনৈতিক গতি। এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে নতুন শক্তি যোগায়, যা ভবিষ্যতে দেশের স্থায়ী উন্নয়নের পাথেয় হয়ে ওঠে। প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রেমিট্যান্সের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ প্রথমত দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেন এবং ঋণ পরিশোধের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন দেশের মুদ্রার মান স্থিতিশীল থাকে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করে। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রবাসী কর্মী গ্রামাঞ্চল থেকে আসে, এবং তাদের পাঠানো অর্থ গ্রামের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতেও সহায়ক। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দিয়ে গ্রামের মানুষরা বাড়িঘর তৈরি করছে, সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি ঘটাচ্ছে। এটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশের কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রবাসীরা যখন অর্থ দেশে পাঠায়, তখন সেই অর্থের একটি বড় অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ হয়। নতুন ব্যবসা গড়ে তোলা, ছোট প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, এবং উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে এই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়।
উদ্যোক্তারা এই অর্থ দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায় যেমন কুটির শিল্প, কৃষি, এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ পান। এটি দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে দৃঢ় করে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে শক্তিশালী করে তোলে।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
রেমিট্যান্সের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অত্যন্ত ইতিবাচক। প্রথমত, এটি দেশের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী যারা প্রাথমিকভাবে দরিদ্র ছিলেন, তারা প্রবাসীদের অর্থের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা দেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করছে। 
দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান দেশের অর্থনীতিতে আধুনিকায়নের ছোঁয়া আনছে। অনেক প্রবাসী তাদের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে এসে নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছেন। তারা দেশে প্রযুক্তি এবং জ্ঞান স্থানান্তর করছেন, যা সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষি খাতে উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ, শিল্প ও আইটি খাতের উন্নয়ন এসব ক্ষেত্রে প্রবাসীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হচ্ছে।
তৃতীয়ত, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে রেমিট্যান্সের অর্থায়ন দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
যদিও রেমিট্যান্স দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে একটি প্রধান চালিকা শক্তি, তবুও এই খাতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক প্রবাসী কর্মী কম দক্ষতার কারণে উচ্চ আয়ের চাকরি পায় না, যার ফলে তাদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ সীমিত হয়। এছাড়াও, বৈদেশিক শ্রমবাজারে বিভিন্ন সময়ে সংকট তৈরি হয়, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

তবে, দক্ষতা উন্নয়ন এবং বৈদেশিক শ্রমবাজারের উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব। সরকারের উচিত প্রবাসী কর্মীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালু করা, যাতে তারা উচ্চ আয়ের কাজ করতে পারে এবং রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে।
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!